সাপুড়ে নজরুলের মৃত্যুর দায় কে নিবে?

সাপুড়ে নজরুলের মৃত্যুর দায় কে নিবে?

Spread the love

ফরিদপুরের চরভাদ্রসনের হাজিগঞ্জে এক মাছ ধরার কারেন্ট জালে একটি সাপ আটকা পড়লে সাপুড়ে নজরুল ইসলামের ডাক পড়ে। প্রথমে তিনি ভাবেন এটি একটি অজগর সাপ। কিন্ত সাপটি ধরতে গিয়ে যখন সাপ দ্বারা আক্রান্ত হন কিছুক্ষণ পরেই তিনি বুঝতে পারেন যে এটা কোন সাধারণ সাপ নয়। ঘটনা এখানেই শেষ হলে হত i। কিন্ত না ,এই ঘটনা ধীরে ধীরে মর্মান্তিক পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়। তিনি যখন বুঝতে পারেন বিষধর সাপ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন এরপর তিনি জীবন্ত সাপ নিয়ে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চলে যান। কিন্ত সাপের কামড়ের চিকিৎসার জন্য কোন অ্যান্টিভেনম সেখানে ছিল না। এরপর তাঁর পরিবার নিজেদের থেকে বত্রিশ হাজার টাকা খরচ করে বহুকষ্টে দুই ডোজ অ্যান্টিভেনমের ব্যবস্থা করে। কিন্ত তার অবস্থার কোন উন্নতি হয় না। তাই এক রাত এবং দুদিন পর সেখানকার ডাক্তার তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন। নজরুলের ভাই লালন মিয়া জানান, ফরিদপুর ও ঢাকায় চিকিৎসায় এক লাখ টাকার বেশি খরচ হয়ে গেছে। পরিবারের নারীদের গয়না যেটুকু ছিল তা–ও বিক্রি করতে হয়েছে। তারপরও ভাইকে বাঁচানো গেল না। এখন আমাদের নিজেদেরই খাবারের পয়সা নাই অবস্থা ii।’

আসুন আমরা এক এক করে উপরের পরিস্থিতিগুলো একটু বিবেচনা করি।

ফরিদপুরের চরভাদ্রসনে রাসেল ভাইপারের উপস্থিতি কিন্ত একেবারে নতুন না। এ সম্পর্কিত খবর যদি আমরা ট্রাক করি তাহলে দেখতে পাই এ সাপের উপস্থিতি নিয়ে প্রথম খবর ছাপানো হয় ২০১৭ সালে। অর্থাৎ এ সাপের ব্যাপক উপস্থিতি প্রথমে রাজশাহী , কুষ্টিয়া এবং পাবনা অঞ্চলে থাকলেও তা ধীরে ধীরে পদ্মার এ পার পর্যন্ত পৌছে যায়। এরপরে গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালেও চরভাদ্রসনে রাসেল ভাইপারের ব্যাপক উপস্থিতি নিয়ে জাতীয় পত্রিকাতে খবর আসে। ইত্তেফাক পত্রিকার গত বছরের এরকম এক শিরোনাম চরভদ্রাসনে রাসেল ভাইপার সাপের আতঙ্ক। এমনকি সাপুড়ে নজরুলের মৃত্যুর প্রায় এক মাস পূর্বে এই চরভাদ্রসনেই লাভলু শেখ নামক আরেক ব্যক্তি সাপ দ্বারা আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এবং সাপ দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার প্রভাব দেখে এটা অনুমান করা যায় যে সে ব্যক্তিও রাসেল ভাইপার দ্বারা আক্রান্ত হন।

রাসেল ভাইপার সাপের নামকরণ যার নামে করা হয় অর্থাৎ প্যাট্রিক রাসেলের ভারতীয় সাপের গতি প্রকৃতি এবং বিষের প্রভাব নিয়ে লিখিত বই Accounts of Indian Serpents, 1796 থেকে নেওয়া। ছবিটির কালার সংস্করণ  Linda Hall Library-র ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া।

 

উপরের প্রাসঙ্গিক আলোচনা বেশকিছু প্রশ্নের জন্ম দেয়।

প্রথম প্রশ্ন হল, যেখানে রাসেল ভাইপার নিয়ে গত পাঁচ বছরেরও অধিক সময় ধরে এত আতঙ্ক সেখানে সাপুড়ে নজরুলের পক্ষে কেন অজগর এবং রাসেল ভাইপারের মধ্যে পার্থক্য করা সম্ভব হল না ! সাপুড়ে নজরুলের সাপ ধরার বর্ণনা পত্রিকাতে যেভাবে এসেছে তাতে বুঝা যায় তাকে যারা সাপ ধরার জন্য ডাকে তারাও সাপটির প্রকৃতির ব্যাপারে জ্ঞাত ছিল না। অর্থাৎ শুধু নজরুল নয় অন্য সাধারণ মানুষও এই সাপের দ্বারা আক্রান্ত হতে পারত। রাসেল ভাইপারের ব্যাপক উপস্থিতির পরেও কি প্রশাসন জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে চরভাদ্রসনে কোন ক্যাম্পেইন করে নি ? যদি করে থাকে তাহলে কি তা আদৌ যথেষ্ট ছিল ? আমাদের মনে রাখতে হবে যে নজরুল সাধারণ পেশার মানুষ নয়। সে পেশাগতভাবেই একজন সাপুড়ে । অর্থাৎ প্রশাসন যদি সাপ নিয়ে সচেতনতামূলক কোন সফল ক্যাম্পেইন পরিচালনা করত তাহলে সেই ক্যাম্পেইনের সুবিধা পাবার সুযোগ সাপুড়েদেরই সবার আগে থাকা উচিত। কিন্ত আমার মনে হয় না আদৌ কোন ক্যাম্পেইন হয়েছে রাসেল ভাইপার নিয়ে।

রাসেল ভাইপার সাপ নিয়ে পর্যাপ্ত পরিমান ক্যাম্পেইন করার মাধ্যমে মানুষকে এই সাপ এবং অজগর সাপের মধ্যকার পার্থ্যক্য বোঝানো সম্ভব। ছবিটি Getty Image থেকে নেওয়া। তুলেছেন Abhinandan Shukla.

 

দ্বিতীয় প্রশ্ন হল, যে উপজেলার মানুষদের রাসেল ভাইপারের মত বিষধর সাপ দ্বারা যেকোন সময়ে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে সেখানের হাসপাতালে বা সেই উপজেলা যেই জেলার অন্তর্গত সেই শহরের হাসপাতালেও কেন অ্যান্টি ভেনম থাকবে না ! এর জবাবদিহি কে করবে ? আপনি দেখবেন প্রশাসন থেকে বিভিন্ন সময় মিডিয়াতে সাপ দ্বারা আক্রান্ত হওয়া নিয়ে বক্তব্য পেশ করা হয়। সেখানে তারা অভিযোগের সুরে বলেন সাপ দ্বারা মানুষ আক্রান্ত হলে মানুষ যে ভুল কাজগুলো করে তাহল ওঝার নিকট যাওয়া। কিন্ত এক্ষেত্রে যা করতে হবে তাহল নিকটস্থ হাসপাতালে যেতে হবে। সাপুড়ে নজরুল কিন্ত সঠিক কাজটাই করেছিল। এমনকি হাসপাতালের ডাক্তারদের জন্য যেন সাপ চিনতে সমস্যা না হয় অর্থাৎ সে কি সাপের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে এটা বুঝতে বুঝতেই যেন তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে না পড়ে্ন এজন্য সে সাপটি ধরে নিয়ে যায়। সে নিজে সাপুড়ে হলেও কখনই তার কল্পনাতে ছিল না যে তাকে এরকম পরিণতি বরণ করতে হবে। অর্থাৎ সাপ দ্বারা আক্রান্ত হলে একজন সচেতন মানুষের যা যা করা দরকার ঠিক সে সেগুলোই করে। কিন্ত আফসোস, প্রশাসনের খামখেয়ালিপনা নজরুল কে ভুগিয়েছে। এবং এর সাথে নজরুলের পরিবারকেও ভুগতে হয়েছে। যে উপজেলাতে রাসেল ভাইপারের আতঙ্ক নিয়ে দুদিন পর পরই জাতীয় পত্রিকাগুলোতে খবর আসছে সেই উপজেলাতে কেন অ্যান্টি ভেনম পাওয়া যাবে না ! মানুষ ওঝার কাছে যায় এর দায়ভার পুরোটাই প্রশাসন কে নিতে হবে। কেননা, প্রশাসন হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত পরিমাণ অ্যান্টি ভেনমের ব্যবস্থা করে রাখে না। দুই, তারা মানুষকে সচেতন করার জন্য পর্যাপ্ত ক্যাম্পেইনও করে না। শুধুমাত্র দিবস কেন্দ্রিক দেখানো ক্যাম্পেইন করেই দায়িত্ব সম্পন্ন করে।

ভারতের পলিভ্যালেন্ট অ্যান্টিভেনম। প্রতি শিশি তে দশ মিলি করে থাকে। ২০২০ সালের দেশের এক পত্রিকাতে উল্লেখ করা হয় এই অ্যান্টিভেনোম বাংলাদেশে এক হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ছবিটি ভারতের জনপ্রিয় বেচাকেনার ওয়েবসাইট India Mart থেকে নেওয়া।

তৃতীয় প্রশ্ন হল, অ্যান্টি ভেনমের এখনো এত দাম কেন ? বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত যে অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করা হয় তা বিদেশ অর্থাৎ ভারত থেকে আনা । তাই অ্যান্টিভেনমের এত দাম হওয়ার পিছনে যৌক্তিক কারণ থাকতে পারে হয়তবা। বিভিন্ন সময় সোশ্যাল মিডিয়াতে লোকাল যে ব্রান্ডগুলো অ্যান্টি ভেনম বানায় বলে ছড়ানো হয় তার একটাও লোকাল মেইড না। সব ম্যাটেরিয়াল ভারত থেকে আনা। ভারতের পলিভ্যালেন্ট অ্যান্টিভেনম বানায় এরকম একটি কোম্পানি ‘Bharat serums & Vaccines Limited’ এর প্রতি শিশির যে মূল্য ওয়েব সাইটে দেখা যাচ্ছে তা হল ৪৬০ রুপি iii। পত্রিকাগুলোতে উল্লেখ করা হয়েছে যে নজরুল বত্রিশ হাজার টাকা দিয়ে বাহিরে থেকে কিনে দুই ডোজ অ্যান্টিভেনম দেয়। অর্থাৎ দুই ডোজ বলতে এখানে দশ দশ বিশ শিশি  বোঝানো হয়েছে। এখানে প্রতি শিশির মূল্য তাহলে দাড়ায় ১৬০০ টাকা। কিন্ত এক জাতীয় দৈনিকে ২০২০ সালের একটি রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় যে প্রতি শিশির দাম ১০০০ টাকায় বাংলাদেশে বিক্রি করা হচ্ছে। ভারতে যে জিনিসের দাম ৪৬০ রুপি সে জিনিসের দাম বাংলাদেশে প্রায় দ্বিগুন তাও ধরে নিলাম এর যৌক্তিকতা আছে । কিন্ত এগুলো লোকাল বাজারে ১৬০০ টাকায় কিভাবে বিক্রি হল ! এখানে কে কাকে ঠকালো এটা আমাদের বের করতে হবে। সাধারণ মানুষ হাসপাতালে অ্যান্টি ভেনম পাবে না। তারপরে নিজ থেকে বাজারে বা ফার্মেসি থেকে কিনতে গেলে সেখানে গিয়ে যদি এক হাজার টাকার জিনিস ১৬০০ টাকাতে কিনতে হয় তাহলে এই জুলুমের শেষ কোথায় ? বাচা মরার ওষুধেও কেন প্রতারনা

বাংলাদেশে বর্তমানে অ্যান্টিভেনোম বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ইনসেপটা। ছবিটি Incepta Vaccine Ltd এর অফিশিয়াল ফেইসবুক পেইজ থেকে নেওয়া।

চতুর্থ প্রশ্ন হল,  এবার যে প্রশ্নের সমাধান দরকার তাহল , ভারতের এই পলিভ্যালেন্ট অ্যান্টিভেনম বাংলাদেশে আক্রান্ত হওয়া রাসেল ভাইপারের বিষের বিরুদ্ধে কতটুকু কার্যকর। কেননা, বহুকাল আগে থেকে বাংলাদেশে এই পলিভ্যালেন্ট অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করা হলেও খোদ ভারতেই এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। গবেষকরা এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে যে সাপের অঞ্চল ভিত্তিক খাদ্যাভ্যাসের মধ্যে পার্থক্য থাকার কারণে একই পলিভ্যালেন্ট অ্যান্টিভেনম সবখানের জন্য কার্যকর নয় v। এমনকি এই একই অ্যান্টিভেনম শ্রীলঙ্কাতেও ব্যবহার করা হয়। কিন্ত এই অ্যান্টিভেনম সেখানকার রাসেল ভাইপার সাপের বিষের বিরুদ্ধে পুরোপুরি কার্যকর হচ্ছে না সে বিষয়টি বিভিন্ন গবেষণাতে উঠে আসেvi। এ সংক্রান্ত আরেকটি গবেষণাতে উল্লেখ করা হয় যে ভারতের অ্যান্টি ভেনম শ্রীলঙ্কাতে রাসেল ভাইপার সাপের বিষ আক্রান্ত মানুষের রক্তের উপর যে প্রভাব ফেলে রক্তক্ষরণ ঘটায় তার  বিরুদ্ধে সফলতার সাথে কাজ করতে পারলেও আক্রান্ত হওয়া পেশীর ক্ষতি কে ব্যহত করতে সক্ষম নয় vii। কিন্ত বাংলাদেশে এই অ্যান্টিভেনম আদৌ রাসেল ভাইপার সাপের বিরুদ্ধে সফলতা দেখাচ্ছে কিনা এ নিয়ে এখন পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে আমরা কোন গবেষণা পাই নি। যা এক রকম আমাদের পাবলিক হেলথ নিয়ে গবেষণার ব্যাপারে অনাগ্রহই প্রকাশ করে বলে আমি মনে করি। কেননা আপনি যদি সাধারণভাবে পলিভ্যালেন্ট অ্যান্টিভেনমের কার্যকারিতা রোগীর উপর কেমন হচ্ছে এটা অভিজ্ঞতার আলোকে প্রমাণ করতে যান তাহলে তা অনেকটা ওঝার বিষ নামানোর মতনই মনে হবে। রাসেল ভাইপার দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে এবং এরপরে অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করা হলে রোগী বেঁচে যাওয়ার রেকর্ড যেমন আছে তদ্রুপ মারা যাওয়ার রেকর্ডও রয়েছে। এখন যেগুলোতে রোগী মারা যায় সেক্ষেত্রে সাধারণভাবে যে প্রশ্ন তোলা হয় যে, রোগীকে সঠিক সময়ে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় নি। কিন্ত একই প্রশ্ন যারা বেঁচে যায় তাদের বেলাতেও করতে পারি। হয়তবা সাপ তাকে ড্রাই বাইট দিয়েছে। অথবা বাইট হলেও পর্যাপ্ত পরিমাণ বিষ ইনজেক্ট হয় নি। অর্থাৎ এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

ভারতের বিষধর সাপের বিষের বিপরীতে পলিভ্যালেন্ট অ্যান্টিভেনোমের কার্যকারিতার ব্যাপারে সাপের ভৌগোলিক ভিন্নতা নিয়ে হার্পেটোলজিস্ট রমালাস হুইটেকার কথা বলেন। তিনি একস্থানে বলেন, সাপের অঞ্চলভিত্তিক বিষের উপাদানে তারতম্য থাকে। অর্থাৎ সাপ এক হলেও অঞ্চলভিত্তিকভাবে সাপের বিষের উপাদানের মধ্যে বিভিন্নতা রয়েছে। তাই আমাদের ভৌগোলিক ভিন্নতার কারণে একই অ্যান্টিভেনম দিয়ে সব কভার করাটা এক সমস্যা বৈকি’। রমালাস হুইটেকারের ছবিটি BBC- র Natural World এ প্রচারিত ‘One million snake bites’ নামক তথ্যচিত্র থেকে নেওয়া।

পঞ্চম প্রশ্ন হল, বিদেশী অ্যান্টিভেনমের উপর নির্ভরশীলতা কেন ? বাংলাদেশ যেন নিজেদের জন্য নিজেরাই অ্যান্টিভেনম বানাতে পারে এজন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ডব্লিউ এইচ ওর নির্দেশনায় ২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এজন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ভেনোম রিসার্চ সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয় viii। আজ ২০২৩ সালের জুলাই মাস চলছে তাদের সফলতা বা ব্যর্থতার কোন গল্পই এখন পর্যন্ত পাবলিক হয় নি। গত পাঁচ বছরে ভেনোম রিসার্চ সেন্টার নিয়ে যতগুলো রিপোর্ট হয়েছে শুধুমাত্র তা তাদের সাপ সংগ্রহ করা , বিষ সংগ্রহ করা এগুলো নিয়েই। ২০২০ সালের এক জাতীয় দৈনিকে উল্লেখ করা হয় ২০২২ সালে তারা অ্যান্টি ভেনোম তৈরিতে যাবে । পত্রিকাতে আরো বলা হয় এই প্রজেক্টের চতুর্থ পর্যায়ে অ্যান্টি ভেনম বিভিন্ন প্রাণীদের উপর পরীক্ষা করে এর কার্যকারিতা পর্যবেক্ষন করা হবে ix। কিন্ত এই পর্যায়ে তারা এখন পর্যন্ত আসতে পেরেছে কিনা তা নিয়ে তাদের কোন রিসার্চ পেপার এখন পর্যন্ত পাবলিশড হয়েছে বলে জানা যায় নি। অর্থাৎ এখন ২০২৩ সালের মধ্যবর্তী সময় চলছে কিন্ত প্ল্যান অনুসারে পাঁচ বছরের মধ্যে তাদের অ্যান্টি ভেনোম উৎপাদনে যাওয়ার কথা ছিল কিন্ত তা যাওয়া সম্ভব হয় নি। এর পিছনে যৌক্তিক কারণ থাকতেই পারে। কিন্ত যেহেতু পুরোটাই সরকারের অর্থ দ্বারা চলমান প্রজেক্ট তাই সাধারণ মানুষের জানার অধিকার রয়েছে যে, কেন আমরা এখনো সফলতার মুখ দেখতে পাচ্ছি না। কি কারণে ট্রায়ালে দেরি হচ্ছে। বা কি কারণে এখনও উচ্চমূল্যে আমাদেরকে বিদেশের অ্যান্টিভেনোম কিনতে হচ্ছে। এই প্রশ্ন উঠা কি স্বাভাবিক নয় ? যেখানে অ্যান্টিভেনোমের উচ্চমূল্যের কারণে নজরুলের মত সাধারণ মানুষেরা মারা যাচ্ছে সেখানে আমাদের আরো কত দিন অপেক্ষা করতে হবে সে প্রশ্ন আমরা তো করতেই পারি।

 

এবং সর্বশেষ প্রশ্ন হল, সাপুড়ে নজরুল কি উপহাসের বিষয় ? এই বিষয়টা নতুন নয় তারপরও বলছি আমাদের বর্ণবাদী চিন্তাভাবনা আমাদেরকে ক্রমান্বয়ে শিখাচ্ছে কিভাবে অসহায় মানুষদেরকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করতে হয়। আমরা যেন মানবতার শেষ পর্যায়ে গিয়ে ঠেকছি। যখন সাপের কামড়ে কোন সাপুড়ের মৃত্যু হয় মানুষ সেটাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করে। কিন্ত কেন ? কোন সাপুড়ে কি আজ পর্যন্ত বলেছে সাপের কামড়ে আমার মৃত্যু হবে না ?

ভারতীয় উপমহাদেশে সাপুড়েদের ইতিহাস বহু পুরাতন। তারা সাপ উদ্ধারের পাশাপাশি বহু আগে থেকেই সাপের খেলা দেখিয়ে আসছে। ছবিটি ইংরেজি ১৯০০ সালের দিকে তোলা। ছবিটি ওয়েব থেকে সংগৃহীত।

আর যদি কোন সাপুড়ের মুখ থেকে আপনি এরকম কোন কথা শুনেও থাকেন তাহলে তা বিজ্ঞাপনের চমকহিসেবে ভাবতে পারেন এথেকে বেশি কিছু নয়। কিন্ত এগুলো কিভাবে একজন মানুষের অসহায়ত্ব কে উপহাস করার যোগান দিতে পারে ! সাপুড়ে নজরুল যখন রাসেল ভাইপার দ্বারা আক্রান্ত হয়ে বিছানাতে ছটফট করছে তখন পত্রিকাতে তাকে নিয়ে প্রতিবেদন হলে সাপুড়েদের প্রতি মানুষের এত নিচ চিন্তা আমাকে ভয় পাইয়ে দেয়। আপনার মনে রাখতে হবে সাপুড়েরা আবহমান কাল থেকে মানুষকে সাপের ক্ষতি থেকে বাচানোর চেষ্টা করে আসছে। খুব অল্প অর্থের বিনিময়ে তারা মানুষের ঘর বাড়ি থেকে বিষধর সাপ উদ্ধার করে মানুষকে নানা রকম বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করে আসছে। যেহেতু সাপ উদ্ধারের ঘটনা কালে ভদ্রে ঘটে অর্থাৎ এটা নিয়মিত ঘটনা নয় তাই বাধ্য হয়েই এদেরকে এমন জীবিকা বেছে নিতে হয় যেখানে অনেক চটকাদার কথাবার্তা থাকে। সাপ তারা কয়দিনই বা উদ্ধার করে ? বেশিরভাগ দিন তাদের এই চটকাদার কাজকারবার করেই চলে। আধুনিক স্নেক রেসকিউর নামে গত কয়েক বছরে হয়তবা অনেক শিক্ষিত ছেলে মেয়ে সাপ উদ্ধার করা শিখেছে কিন্ত তাদের সংখ্যা এখনো নগন্য। অর্থাৎ আপনাদের পক্ষে পুরো বাংলাদেশে সার্ভিস দেওয়া সম্ভব নয়। আধুনিক স্নেক রেসকিউ টিমগুলোর হয়তবা সাপ নিয়ে টেক্সটবুক এডুকেশন আছে তার মানে এই নয় আপনি সাপুড়েদের সাপ উদ্ধার করার কাজকে এখন নগন্য মনে করতে শুরু করবেন। বরং এই আধুনিক শিক্ষিত স্নেক রেসকিউয়ার টিমদেরই উচিত ছিল সাপের ব্যাপারে সাপুড়েদের কাছে ক্যাম্পেইন করা। তাদেরকে বুঝানো অজগর এবং রাসেল ভাইপারের মধ্যে পার্থক্য কি ।

এগুলো আমরা কতজনই বা করছি। কিন্ত দেখলাম এখনো মানুষ সেই মুখস্ত কথাই আউড়িয়ে যাচ্ছে। তারা জানেও না, সাপুড়ে নজরুলের মৃত্যু কি করে হয়েছে। তারা সাপুড়ে নজরুলের মৃত্যুর খবরের শিরোনাম দেখেই শেয়ার করে বসছে যে সাপে কামড় দিলে প্রথমেই আপনাকে হাসপাতালে যেতে হবে । ওঝা আপনার জীবন বাচাতে পারবে না। কত বড় বেখেয়ালি হলে মানুষ এরকম কাজ করতে পারে। সাপুড়ে নজরুল যেখানে প্রথমেই হাসপাতালে গিয়েছে এবং সে কোন ওঝার কাছে যায় নি। কিন্ত এই কথিত শিক্ষিত সুপ্রেমেসীতে ভোগা তরুন সমাজ প্রতিবেদন বিস্তারিত না পড়েই সাপুড়ে নজরুল কে অজ্ঞ , অসচেতন বানিয়ে দিচ্ছে। আমরা তরুনেরাও সেই একই ভুলের মাশুল দিচ্ছি। প্রশাসনের শিখানো মুখস্ত কথাই আমরা আউড়িয়ে বেড়াচ্ছি। ওঝা নয়, হাসপাতাল। কিন্ত হাসপাতালে ভ্যাক্সিন নেই সেই কথা কেন কেউ জোরে শোরে বলে না। হাসপাতালে গিয়ে শুয়ে থাকলেই কি মানুষ সুস্থ হয়ে যাবে ! আরো গুরুত্বপূর্ণ কথা হল রাসেল ভাইপার দ্বারা আক্রান্ত হলে এর একমাত্র চিকিৎসা কিন্ত অ্যান্টি ভেনোম নয় । এর পাশাপাশি রোগীকে ডায়ালাইসিস করার প্রয়োজন পড়তে পারে x। এবং এটা খুবই জরুরী হয়ে দাড়ায়। এখন এই মেশিন আদৌ রাসেল ভাইপার সংশ্লিষ্ট এলাকা গুলোতে আছে কিনা তারই তো কোন খোঁজ নেই। এর আগে ২০১৫ সালে দেশের শীর্ষস্থানীয় এক পত্রিকাতে রাসেল ভাইপার নিয়ে প্রতিবেদনে আইসিউর একজন চিকিৎসক রাসেল ভাইপার সাপ দ্বারা আক্রান্ত দুজন ব্যক্তির কথা উল্লেখ করেন। যাদের হাত পা কেটেও বাঁচানো যায় নি। কেননা তাদের কিডনি আগেই অচল হয়ে গিয়েছিল। প্রতিবেদনের শেষে বলা হয় রাসেল ভাইপার সাপ দ্বারা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটি যন্ত্র দেওয়া হয়েছে । আর এই যন্ত্রটি চালু রাখার জন্য প্রতি বাহাত্তর ঘন্টাতে একটি সার্কিটের প্রয়োজন হয়। সেই সার্কিটের দাম আবার ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার টাকা। সরকারিভাবে আবার এই সার্কিটের সরবরাহের কোন ব্যবস্থা নেই xi। যদিও প্রতিবেদনটিতে মেশিনের নাম উল্লেখ করা হয় নি তবে মেশিনের বর্ণনার ধরন দেখে একে উন্নত প্রযুক্তির কোন ডায়ালাইসিস মেশিন বলে মনে হচ্ছে। এবং এটা ২০১৫ সালের প্রতিবেদন হলেও আমার মনে হয় না দৃশ্যপটের খুব বেশি পরিবর্তন হয়েছে।  

তাই সাধারণ অ্যাক্টিভিস্টদের উচিত নয় একমুখী কথা বলা। সাধারণ মানুষকে সাপের ব্যাপারে সচেতন করুন। সাপ দ্বারা আক্রান্ত হলে মানুষকে ওঝার নিকট না গিয়ে হাসপাতালে যেতে বলুন, সবই ঠিক আছে। কিন্ত প্রশাসন যে বরাবরই সাপ সংক্রান্ত সব ব্যাপারে সাধারণ মানুষের জীবন বাঁচানো নিয়ে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে আসছে এ ব্যাপারে আপনার কি কিছুই বলার নেই ? নাকি যত দোষ সব একমাত্র মূর্খ সাপুড়েদের ! আপনার মনে রাখা দরকার এখন যে পলিভ্যালেন্ট অ্যান্টিভেনোম ব্যবহার করা হচ্ছে এর পিছনেও সাপুড়েদের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। কেননা এই অ্যান্টিভেনোম বানানোর জন্য যে বিষ সংগ্রহ করা হয় তার প্রায় পুরোটাই করে ভারতের ইরুলা আদিবাসীর লোকজন। এরাও সাপুড়েদের মত আগে সাপ ধরত এবং সাপের খেলা দেখিয়ে জীবিকা অর্জন করত।।

ভারতের ইরুলা জনগোষ্ঠী সাপ উদ্ধার করছে। ছবিটি 60 Minutes Australia-র ‘ The Indian ‘Irulas tribe’ snake and rat busters’ নামক তথ্যচিত্র থেকে নেওয়া। 

কিন্ত পরবর্তীতে এদেরকে সুষম কাঠামোর মধ্যে এনে এদের কাজকে জনগণের কল্যানের জন্য ব্যবহার করা হয়। সেই কাঠামোর অংশ হিসেবে তারা সাপ ধরে সাপের বিষ সংগ্রহ করে এবং তা বিক্রি করে জীবিকা উপার্যন করে এবং সেই বিষ দিয়ে বানানো হচ্ছে অ্যান্টিভেনোম। যা উপমহাদেশের অসংখ্য মানুষের জীবন বাচানোর জন্য ব্যবহার হচ্ছে। তাই সাপুড়েদের কে অবহেলা না করে তাদেরকে মূল কাঠামোর সাথে জড়ানোর চেষ্টা করুন। দেখবেন এর উপকার সবাই পাবে। 

 

 

ivপড়ুনঃ WHO থেকে প্রকাশিত Guidelines For the management of Snake-Bites; Annex 2; Page :140

xএ ব্যাপারে জানাকি লেনিনের আর্টিকেলটি পড়ুনঃ A million snake bites (downtoearth.org.in)

xiভয়ংকর বিষধর রাসেল ভাইপার‘ | প্রথম আলো (prothomalo.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.