কালাচের নীরব ঘাতক হওয়ার পিছনে যত কারণ , বিস্তারিত প্রবন্ধ

কালাচের নীরব ঘাতক হওয়ার পিছনে যত কারণ , বিস্তারিত প্রবন্ধ

Spread the love

আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহে বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল এবং শ্রীলঙ্কাতে বর্ষাকাল এলেই সাপের কামড়ে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকে। এই মৃত্যুগুলো খুবই দুঃখজনক। কিছু সাপের দংশনে মানুষের মৃত্যু এরকম হয় যে , যাকে সাপ দংশন করে সে নিজেও অনেক দেরিতে বুঝে যে তার চিকিৎসার প্রয়োজন রয়েছে অথবা তাকে হাসপাতালে গিয়ে এ্যান্টি ভেনোমের ব্যবস্থা নিতে হবে এ জিনিস বোঝার আগেই সে মৃত্যুকোলে ঢলে পড়ে। এই অভিজ্ঞতা হয় মূলত কালাচ নামক সাপ দ্বারা আক্রান্ত হলে। আর এই সাপের দংশনে মৃত্যুর বেশিরভাগ ঘটনাই ঘটে ঘরের ভিতরে। যা আরো দুঃখজনক।

ভারতের ‘বিগ ফোর’ স্নেকের মধ্যে কালাচ অন্যতম। ছবিতে অন্যান্য বিষধর সাপের সাথে কালাচ কে দেখা যাচ্ছে। ছবিটি সাপের বিষ অ্যান্টি ভেনম তৈরিতে বিষ সংগ্রহ করা হয় এরকম এক স্থান থেকে তোলা। ছবিটি তুলেছেন অরুণ শঙ্করের ( Arun Sankar). এবং এটি গেটি ইমেজের সংগ্রহশালা থেকে নেওয়া হয়েছে।

 

তাই এ বিষয়টিকে আমার নিকট আলাদাভাবে গুরুত্ব দেওয়ার মত বিষয় মনে হয়েছে যে কারণে আমি কালাচের ( Common krait ; Sci Name: Bungarus careruleus) ঘরে আসার সম্ভাব্য কারণ নিয়ে এখানে বিস্তারিত আলোচনা করব। বাংলাদেশে মেডিক্যালি এটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি সাপ। বাংলাদেশে সর্প দংশনে মৃত্যু সংক্রান্ত খবর নিয়ে পত্রিকাগুলোতে যে রিপোর্ট হয় তার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাপের নাম উল্লেখ থাকে না। আবার কোন সাপের নাম তারা উল্লেখ করলেও দেখা যায় যে সেই রিপোর্টের সাথে যে সাপের ছবি দেওয়া রয়েছে সেই ছবির সাথে রিপোর্টে উল্লেখিত সাপের কোন মিল নেই। তাই এটা বের করা মুশকিল যে বাংলাদেশে কি পরিমাণ লোক কালাচ দ্বারা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। তবে ভারতে সাপের দংশনে যতজন মৃত্যুবরণ করে তার বড় একটা অংশ এই কালাচের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। ভারতের বিগ ফোরস্নেকের একটি সাপ হল এই কালাচ। কালাচ বলতে কমন ক্রেইট বুঝানো হলেও এর পাশাপাশি Bungarus গোত্রের অন্যান্য সাপের মধ্যেও কাছাকাছি বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। অর্থাৎ ঘরে এসে দংশন করার চেষ্টা করা হতে শুরু করে দংশনের পরবর্তী লক্ষণসমূহ সহ অনেক কিছুর সাথেই এদের নিজেদের মধ্যকার মিল রয়েছে। তাই এই আর্টিকেলটি অন্যান্য Bugnarus গণের সাপের ক্ষেত্রেও খাটবে। বিশেষ করে কাল কেউটে (Greater Black Krait; Sci Name: Bungarus niger), ওয়ালস ক্রেইট ( Walls Krait ; Sci Name: Bungarus walli); শঙ্খিনী (Banded Krait; Sci Name: Bungarus fasciatus) এবং ছোট কাল কেউটে (Lesser Black Krait; Sci Name: Bungarus lividus)

ছোট কাল কেউটে বা (Lesser Black Krait; Sci Name: Bungarus lividus). আচরণের দিক থেকেও এটিও কালাচের (Common Krait) মতই আচরণ করে থাকে। ছবিটি Sp. Herp-এর তোলা এবং Wikimedia থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।

.১ কালাচের ঘরে আসার সম্ভাব্য কারণ

শ্রীলঙ্কার প্রয়াত হার্পেটোলজিস্ট আনসেম ডে সিলভা (Anslem de Silva)তার এক সাক্ষাৎকারে বলেন ,গ্রামাঞ্চলে ঘরের ভিতর বেশিরভাগ অঘটন ঘটে মূলত ক্রেইটের দ্বারা ( Bungarus careruleus )i এছাড়া বিবিসির ন্যাচারাল ওয়ার্ল্ড প্রোগ্রামে প্রচারিত ডকুমেন্টারি One million Snake Bitesডকুমেন্টারিতে কালাচের ব্যাপারে বলা হয় , ভারত উপমহাদেশের অন্যতম বিষাক্ত এই সাপটিকে ঘরে প্রবেশ করার ব্যাপারে বিশেষ ঝোঁক দেখা যায়। সাপ সাধারণত খাবারের খোঁজে ঘরে প্রবেশ করে। কিন্ত কালাচের প্রবেশের কারণ অজানা ! এবং এই সাপ মানুষের ঘুমের ভিতরে দংশন করার জন্য বিশেষভাবে আলোচিত ii

কালাচ ( Common krait ; Sci Name: Bungarus careruleus) মানুষের ঘরে প্রবেশ করছে। ছবিটি BBC-র Natural World এর One Million Snake Bite থেকে নেওয়া। ছবিটি ড্রামাটাইজ করে তৈরি করা হয়েছে।

 

কালাচ সাপ দ্বারা যত জন আক্রান্ত হয় তার ভালো একটি অংশ আক্রান্ত হয় নিজ ঘরে বসে রাতে ঘুমের মধ্যে। কালাচ কেন মানুষের ঘরে এরকম চলে আসে তা এখনো রহস্য। আরো আশ্চর্য ব্যাপার হল এরা মানুষের অবস্থান কে অনুসরণ করে। অর্থাৎ মানুষ যেখানে থাকে বিছানাতে বা সোফা বা উঁচু কোন স্থানে সেখানেই কালাচ গিয়ে হাজির হয়। কালাচের এ আচরণ আজ পর্যন্ত রহস্যের যোগান দিয়ে যাচ্ছে। কালাচের এরকম আচরণের কারণ কি তা নিয়ে হার্পিটোলজিস্টদের মধ্যেও বিতর্ক রয়েছে। বিশিষ্ট ভারতীয় হার্পিটোলজিস্ট কেদার ভিরে (Kedar Bhide)র মতে , কালাচ যখন রাতে বের হয় তখন রাতের শেষ অংশে তার স্বভাব হল উষ্ণ স্থান খোঁজা। এবং সেখানে সকাল হওয়া পর্যন্ত আশ্রয় নেওয়া। তো, হতে পারে এ কারণে তখন সে কম্বল, বা চাদরের মধ্যে যেখানে মানুষ ঘুমন্ত অবস্থায় থাকে সেখানে সে প্রবেশ করে ওখানে রাত যা কালাচের জন্য মূলত দিনকে কেন্দ্র করে সে আশ্রয় নেয়। এরপর মানুষ যখন ঘুমের মধ্যে নড়াচড়া করে তখন কালাচ স্বাভাবিকভাবেই হুমকি মনে করে দংশন করে।

কালাচ ( Common krait ; Sci Name: Bungarus careruleus) মানুষ ঘুমিয়ে আছে এরকম কম্বলের ভিতর প্রবেশ করছে। ছবিটি BBC-র Natural World এর One Million Snake Bite থেকে নেওয়া। ছবিটি ড্রামাটাইজ করে তৈরি করা হয়েছে।

কিন্ত হার্পিটোলজিস্ট রমালাস হুইটেকার (Romulus Whitaker) মনে করেন ভিন্ন কিছু। রম মনে করেন , কালাচ ইঁদুরের গন্ধের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ঘরে প্রবেশ করে। সাধারণত ইঁদুরের চলাফেরার কারণে ইঁদুরের গন্ধ চাদরে, ম্যাট্রেসে অনেক সময় থেকে যায়। এগুলোর প্রতি আকৃষ্ট হয়েই মূলত কম্বল বা চাদরের ভিতরে প্রবেশ করে। মানুষ নড়াচড়া করে উঠলে তখন সাপ এই নড়াচড়াকে হুমকি মনে করে দংশন করে বসে। সেক্ষেত্র কঠিন পরিশ্রমী ব্যক্তিদের আক্রান্ত হওয়ার সুযোগ কম। কেননা তারা সারাদিনের কঠিন পরিশ্রম শেষে একেবারে এক দীর্ঘ নড়াচড়া বিহীন ঘুম দেয়। সেক্ষেত্রে কালাচের বিরক্ত হওয়ার সম্ভাবনাও কম।

তবে, কেদার ভির রমের ইঁদুরের ঘ্রাণ তত্ত্বের ব্যাপারে আশ্বস্ত নন। তার পাল্টা প্রশ্ন হল, যদি এটা ইঁদুরের কারণেই হত তাহলে অন্যান্য ইঁদুর খেকো সাপদের ক্ষেত্রে কেন তা ঘটে না। কেন তারা বিছানা পর্যন্ত উঠে আসে না !

 

ঘরে কালাচ আসার কারণ কি ঘরের ইঁদুর ! ছবিটি তুলেছে প্রবন্ধের লেখক Saowabullah Haque

রম এটা মেনে নেন যে এ প্রশ্নের উত্তর কোন সঠিক পরিবেশে পুরোপুরি আয়ত্ত্বাধীন পরীক্ষার মাধ্যমে বের করা সম্ভব হতে পারে iii

রমের সহধর্মীনি জানাকি লেনিনে ( Janaki Lenin)রমকে নিয়ে লেখা বই My husband and other Animals 2তে কালাচ সাপ নিয়ে বেশ কিছু চমকপ্রদ তথ্য উপস্থাপন করেন। এখানে জানাকি বলেন, ‘ কালাচ নিয়ে প্রধান সমস্যা হল এ সাপ মানুষের ঘরে গভীর রাতে প্রবেশ করে এবং মানুষকে ঘুমন্ত অবস্থাতেই দংশন করে বসে। কালাচ দেয়াল এবং দরজার ফাঁক ফোকর দিয়ে ঘরে প্রবেশ করে বিশেষ করে বর্ষাকালে। এই সাপ দেয়ালের সাথে অনেকটা হামাগুড়ি দিয়ে বা দেয়াল বেয়ে যেকোন জায়গায় পৌছাতে পারে।

খানে জানাকি একটি কথা উল্লেখ করে যে, মানুষ কালাচ কে নিজের দিকে আকর্ষন করে কেননা মানুষের শরীরের গন্ধ শিকারের গন্ধের মত ব্যবহার হয়। মানুষের শরীরের তাপমাত্রা ঠান্ডা রক্তের সাপকে আকর্ষিত করে। কালাচ এ সময় খুব ক্ষুধার্ত থাকে যে কারণে তারা এ সময় মানুষের শরীরের অংশ কে নিজেদের খাবার ভেবে বসে। রম (রমালাস হুইটেকার) মনে করে , কালাচ মানুষের শরীরের গন্ধ দ্বারা নির্দেশিত হয় অর্থাৎ মানুষের শরীরের কোন গন্ধ কালাচ কে তার খাবারের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় ivতবে ভারতের আরেকজন হার্পিটোলজিস্ট নীলিম কুমার খৈর ( Neelim Kumar Khaire ) তার বইতে উল্লেখ করেন যে, কালাচ বা এ ধরণের সাপেরা মানুষের ঘরে খাবার যেমনঃ ইঁদুর, বা গিরগিটি এগুলোর সন্ধানে প্রবেশ করে v

জেরি মার্টিন (বামে) এবং রমালাস হুইটেকার ( ডানে) উভয়েই কালাচ সাপ ধরে আছেন। ছবিটি Hindustan Times এর The Goodnight Killer-শিরোনামের প্রতিবেদন থেকে নেওয়া।

অর্থাৎ যদি জিজ্ঞেস করা হয় কালাচ কে কেন অন্যসাপের তুলনায় মানুষের ঘরে বেশি প্রবেশ করতে দেখা যায় র বায়োনারি উত্তর এখন পর্যন্ত দেওয়া এক রকম অসম্ভবই বটে। হার্পিটোলজিস্ট জেরি মার্টিন (Gerry martin) কালাচ নিয়ে তাঁর লেখা এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, ‘মানুষের ঘুমের অবস্থায় কালাচের দংশন নিয়ে বেশ বিতর্ক রয়েছে। গ্রামীণ ভারতে সাধারণত মানুষ ঘরের মেঝে বা ঘরের সামনে খোলা স্থানে শয়ন করে। বিশেষ করে মহারাষ্ট্রে একথা বলা হয় যে , যারা মেঝে শয়ন করে কালাচ এসে তাদেরকে দংশন করে। কিছুদিন আগেও ধরে নেওয়া হত যে মানুষ যখন ঘুমের মধ্যে সাপের শরীরের উপর ঘুরে বা এপাশ থেকে ওপাশ করে তখন হয়তবা সাপ নিজেকে রক্ষার জন্য ঐ মানুষকে দংশন করে বসে। শুধুমাত্র এই একটি কারণকে গ্রহণ করলে সে হিসেবে মহারাষ্ট্রে প্রতি বছর কালাচ দ্বারা আক্রমণের পরিমাণ এর থেকেও ঢের বেশি রেকর্ড হচ্ছে। আরেকটি কারণ হতে পারে কালাচ হয়তবা তার খাবারের খোঁজে মানুষের ঘরে প্রবেশ করে। বিশেষ করে চাদর, কম্বল, এমনকি মানুষের জামা কাপড়েও অনেক সময় ইঁদুরের ঘ্রাণ লেগে থাকে। যেকারণে সাপ তার খাবারের সন্ধানে অন্ধকার রাতে ভুল কিছুর সন্ধান করে বসে। সাপকে আটকাবস্থায় তার খাবার নিয়ে এরকম প্রতিক্রিয়া পাওয়া গিয়েছে যেখানে সাপ শিকারি হিসেবে কামড় বসায়। অর্থাৎ যতটা না আত্মরক্ষার অংশ হিসেবে সে এই কামড় বসায় তার থেকে বেশি সেখানে শিকারী হিসেবে শিকার করার মোটিভ পাওয়া যায়। অর্থাৎ সে যাকে আক্রান্ত করে তাকে সে তার শিকার মনে করে। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে সাপ অনেক বেশি বিষ ভিক্টিমের শরীরে প্রবেশ করায়। যদিও এগুলো এখন পর্যন্ত জল্পনা বা হাইপোথিসিস। এগুলো যতদিন পর্যন্ত নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে প্রমাণ করা সম্ভব না হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত কোন সিদ্ধান্তে পৌছানো সম্ভব হচ্ছে নাvi

ভারতের ইরুলা জনগোষ্টি কালাচ সাপ থেকে বিষ সংগ্রহ করছে। ছবিটি 60 Minutes Australia- র The Indian ‘Irulas tribe’ snake and rat busters (1990) থেকে নেওয়া। 

.২ কালাচ কি বাড়ি ঘরের উচুস্থানে আসতে অক্ষম

কালাচ বরাবরই অসংখ্য প্রশ্নের জন্ম দিয়ে আসছে আর এক্ষেত্রেও নতুন নয়। কালাচের ব্যাপারে অনেকেরই ধারণা যে এ সাপ বাসা বাড়ির উচু স্থানে উঠতে পারে না। এ বিষয়টি নিয়ে আলাদা করে লেখার দরকার হত না যদি BBC News বাংলাতে এ নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশিত না হত। ২০১৯ সালে বিবিসি বাংলার কালাচ সংক্রান্ত এক রিপোর্টে ডা. আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ নামক একজনের বিবৃতি তুলে ধরা হয়। সেখানে তিনি বলেছেন, “ কেউটে প্রজাতির কোন সাপই উঁচুতে উঠতে পারে না। ফলে সাধারণত নিচে থাকে এমন অবস্থায় দংশন করে। এই রিপোর্ট টি পড়ে আমার নিকট মনে হয়েছে বিষয়টি একটু ভালো করে তলিয়ে দেখা দরকার।

মূলত পাক ভারত উপমহাদেশের সব সাপেরই শারীরিক গঠন এরকম যে তারা চাইলে গাছে বা অমসৃন দেয়াল বেয়ে উঁচু স্থানে উঠতে পারে। যেখানে ময়ালের মত ভারী সাপ উঁচু স্থানে উঠে যায় সেখানে কালাচের ব্যাপারটি তো নিতান্ত ছেলেখেলা। ২০২০ সালে Journal of Herpetology’- তে নেপালের গবেষকদের কালাচ সংক্রান্ত একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। এই গবেষণাটি মূলত ছিল কালাচের খাদ্যভ্যাস নিয়ে। গবেষণাতে বিভিন্ন সময়ে মানুষ যে সব কালাচের দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং আক্রান্ত হওয়ার পর মেরে ফেলে এরকম ৬১ টি সাপের উপর গবেষণাটি করা হয়। এই ৬১ টি সাপের মধ্যে ত্রিশ টি সাপের দ্বারাই মানুষ দংশনের শিকার হয় নিজ বিছানাতে। আর মেঝে, বারান্দা, দরজা থেকে পাঁচেরও কম সংখ্যক সাপ দ্বারা দংশনের শিকার হয় vii

২০২০ সালে Journal of Herpetology- তে কালাচ নিয়ে এক গবেষণাতে দেখা যায় যে, কালাচ দ্বারা মানুষের আক্রান্ত হওয়ার যতগুলো ঘটনা ঘটেছে তার প্রায় সবকটাই বিছানাতে। ছবিটি সংশ্লিষ্ট নিবন্ধ থেকে নেওয়া।

এছাড়া জানাকি লেনিনের কালাচ সংক্রান্ত প্রবন্ধেও বিষয়টি উঠে এসেছে। জানাকি লিখেন, এ বিষয়টি আমার মনে অনেক আগে থেকেই প্রশ্নের জন্ম দিয়ে আসছে যে কালাচের দংশন থেকে বাঁচার জন্য কি করা দরকার। অবশ্যই এর উত্তর হবে মেঝেতে ঘুমানো বন্ধ করা। যদিও আমি এতদিন ভাবতাম এটা এক কার্যকর উপায়। ধরে নিয়েছিলাম এক্ষেত্রে বাড়ির দোতালাতে ঘুমানো আরো ভাল সিদ্ধান্ত । কিন্ত সাম্প্রতিক সময়ে নেপালের এক গবেষণায়viii দেখা গিয়েছে কালাচের দ্বারা যারা আক্রান্ত হয়েছে তাদের সত্তর ভাগই দংশনের শিকার হয় নিজ খাটে ঘুমানো অবস্থায় আর সত্তর ভাগেরও বেশি মানুষের বসবাস ছিল ঘরের দোতালাতে। এটা আশ্চর্যজনক এক তথ্য। কেননা কালাচ কে সাধারণত দেখা যায় এরা আরোহণ করে উঁচু স্থানে উঠাকে এড়িয়ে চলে। কিন্ত নেপালের স্ট্যাডিতে দেখা গেল যে তারা হাতের নাগালের বাহিরে থাকা মানুষকেও দংশন করছে। এ ক্ষেত্রে কালাচের দংশনথেকে বাঁচার উত্তম উপায় হল মশারি টাঙ্গিয়ে ঘুমানো। কালাচ যেভাবে খাটের পায়া বেয়ে বিছানায় চলে আসে বা সিড়ি বেয়ে মানুষের কাছে চলে আসে সেক্ষেত্রে আমার বলতে হবে রমের (Romulus Whitaker) ভাষ্য সঠিক। মানুষের শরীরের ঘ্রাণ কালাচ কে ঐভাবে কাছে টানে ঠিক যেভাবে ফুলের মধু মৌমাছিকে কাছে টানে ix

 

একটি কালাচ সাপ কে ঘর থেকে উদ্ধার করা হয়। ছবিটি Hindustan Times থেকে নেওয়া।

 

এছাড়া হার্পিটোলজিস্ট নীলিম কুমার ( Neelim Kumar Khaire )- এর বইতেও কালাচ জাতীয় সাপের বাড়ি ঘরের উঁচু স্থানে খাবারের সন্ধানে উঠতে পারে বলে উল্লেখ করা হয় এবং এটা যে তার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষন তাও সেখানে বলা হয় x

আমি ব্যক্তিগতভাবে হার্পিটোলজিস্ট কেদার ভির (Kedar Bhide)-কে কালাচের ব্যাপারে তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা জানতে চেয়ে মেইল করি। মেইলের রিপ্লাইতে তিনি আমাকে জানান ২০০১ সালে তিনি একবার আট তলা থেকে কালাচ উদ্ধার করেন। এতটুকুই আমাকে তিনি জানান xi

কালাচ কি করে আটতলাতে উঠল এর হয়তবা নানা রকম ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব। কিন্ত এ বিষয়টি নাকচ করে দেওয়া সম্ভব নয় যে কালাচের পক্ষে দেয়াল বা সিড়ি বেয়ে উপরে উঠা সম্ভব । বাস্তবতা হল, কালাচ জাতীয় সাপের মূল খাবার হল অন্যান্য সাপ। অর্থাৎ তার খাবার যেখানে তার অবস্থানও সেখানে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। অন্যান্য ভূমির সাপকে অনুসরণ করে এরাও বিভিন্ন গর্তে যাওয়া আসা করে যেকারণে খাবারের সন্ধানে এই সাপের বেশিরভাগ সময়েই ভূমিতেই থাকতে হয় বা খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া উঁচু স্থানে উঠার প্রয়োজন পড়ে না। এছাড়া যে সমস্ত ঘরে এই সাপ প্রবেশ করে সে সব ঘর উঁচু পাটাতনে অর্থাৎ সরাসরি মাটির লেভেলের সাথে সমান করে ঘর করা হয় খুবই কম। অর্থাৎ কমপক্ষে এক ফিট বা দেড় ফিট উঁচু করে ঘর করা হয় সে ঘর সমূহতেও কালাচ খুব সহজেই প্রবেশ করে। এছাড়া কালাচ দেয়ালের যে ফাকা স্থানে থাকে সেটাও তিন চার ফুট উপরে দেখতে পাওয়া যায়। তাছাড়া মানুষের অবস্থান কে টার্গেট করে সোফা, বিছানা ইত্যাদি স্থানেও কালাচ সাপ কে চলে আসতে দেখা গিয়েছে। অর্থাৎ কালাচের জন্য উঁচু স্থানে আসাটা বিরল কিন্ত অসম্ভব নয়। 

প্রাসঙ্গিকক্রমে অস্ট্রেলিয়ার সাপ গবেষকদের বিষাক্ত সাপদের উপরে বেয়ে উঠা নিয়ে এ সংক্রান্ত একটি সাম্প্রতিক গবেষণার আলোচনা না তুললেই নয়। অস্ট্রেলিয়াতে অনেক আগে থেকেই প্রতিষ্ঠিত আছে যে বিষাক্ত সাপ গাছ বেয়ে উপরে উঠতে পারে না। এমনকি অসিদের মধ্যে প্রচলিত যে,যদি কোন সাপকে দেখ গাছ বেয়ে উঠছে তাহলে নিশ্চিন্তে থাক যে এ সাপ হয়তবা অজগর আর নয়তো কোন নিরীহ নির্বিষ কোন গাছের সাপ। কিন্ত সাম্প্রতিক সময়ে এই মিথকে তিন অস্ট্রেলিয়ান গবেষক ভুল প্রমাণ করে ‘Herpetology Notes’ –এ পেপার প্রকাশ করেন। তাদের গবেষণাতে সাধারণ অবস্থায় বিষ প্রজাতির বিষধর অস্ট্রেলিয়ান সাপের মধ্যে গাছ বেয়ে উঠার সামর্থ দেখা যায়। তারা চাইলেই গাছ বেয়ে উপরে উঠতে পারে। এই সমীক্ষাটি করা হয় গবেষণা, ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ, এবং বিভিন্ন চাক্ষুষ উদাহরণের মাধ্যমে। আর যখন সাপ বিভিন্ন চরমপন্থা বা জটিল পরিবেশের সম্মখীন হয় যেমনঃ শিকারী কোন প্রাণী থেকে থেকে বাঁচার জন্য , বন্যার পানি বৃদ্ধি পেলে ইত্যাদি বিভিন্ন বিরূপ পরিবেশের সম্মখীন হলে গাছে উঠতে পারার ক্ষমতা আরো কিছু সাপ হতে প্রকাশ পায়। মোট একত্রিশ প্রজাতিতে সংখ্যাটি উন্নীত হয়। যদিও গবেষকেরা অধিকাংশ অস্ট্রেলিয়ান সাপ নিয়েই গবেষণা করতে পারেন নি তাই বলাই যায় বাস্তব সংখ্যাটি আরো অধিক হবে । এই একত্রিশটি প্রজাতির সব সাপই এলাপিডি (Elapidae) গোত্রের xii

আমাদের আলোচিত কালাচ সাপও একই গোত্রের। টেরিস্ট্রিয়াল বা ভূমির সাপদেরকে আমরা ভূমিতেই দেখতে পাব সেটাই স্বাভাবিক কিন্ত এর মানে এই নয় যে এই ভূমির সাপেরা সাতার জানে না। আমরা কম বেশি সবাই জানি যে প্রায় সব সাপই অত্যন্ত ভাল সাতারু সে পানির সাপ হোক আর ভূমির সাপ হোক। ঠিক একইভাবে কালাচ সাপ উপরে উঠতে পারে না এরকম বলে দেওয়াটা পুরোই অপরিপক্ক একটি কথা। কালাচের ব্যাপারে যেকোন স্থানেই সাবধান থাকা উচিত। তবে যেকোন সাপই মেঝে থেকে মানুষকে দংশন করতে পারে। সেক্ষেত্রে উপরে ঘুমানোটাই বেশি নিরাপত্তার কারণ।

তবে স্বাভাবিকভাবে এটা বাস্তব যে মেঝে থেকে যে যত উপরে থাকবে তার পক্ষে কালাচের দ্বারাও দংশনের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা স্বাভাবিকভাবে তত কম থাকবে। এর স্বপক্ষে শ্রীলঙ্কার একটি গবেষণা রয়েছে। সেখানে দুটো গ্রাম কে বাছাই করা হয় যে গ্রাম দুটোতে কালাচের দ্বারা প্রায়ই আক্রান্ত হওয়ার রেকর্ড রয়েছে। গবেষকেরা দুটো গ্রামের লোকদেরকেই প্রথমে সাপ সম্পর্কে সচেতন করে। সাপ বাড়িতে কেন আসে, ঝোপ ঝাড় পরিষ্কার করা কেন দরকার ইত্যাদি ব্যাপারে উভয় গ্রামবাসীকেই তারা সচেতন করে। এরপর তারা শুধুমাত্র একটি গ্রামের লোকদের কিছু খাট প্রদান করে। ছয় মাসের ফলো আপে দেখা যায় দুটো গ্রামের কোন সদস্যকেই কালাচ দংশন করে নি। খাটে ঘুমানোর কারণে কালাচের দংশনথেকে এক গ্রামের লোকেরা তো বাচল এটা সহজেই ধরে নেওয়া যায়। কিন্ত অন্য গ্রামের লোকরা যে দংশনের শিকার হল না এর কারণ কি হতে পারে। সাপের ব্যাপারে সচেতন করাটাই হয়তবা সাপের দংশনের দ্বারা শিকার না হওয়ার মূল কারণ হতে পারে। হয়তবা যে গ্রামবাসীদের খাট দেওয়া হয়েছে তারাও ঐ একই কারণে কালাচের দ্বারা আর দংশিত হয় নি xiii

.৩ সর্বশেষ কথা

কালাচের ব্যাপারটি মাথায় রেখে ঘুমানোর সময় মানুষকে বিশেষভাবে নিরাপত্তা নিতে হবে। এক্ষেত্রে যত সম্ভব উপরে ঘুমানো এবং মশারি ব্যবহার করা। এ দুটো বিষয় কালাচ থেকে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি পুরোপুরি নাকচ না করে দিলেও রিস্ক ফ্যাক্টর কমিয়ে আনবে।

মশারি টাঙ্গিয়ে ঘুমালে আশা করা যায় কালাচ দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশে কমে আসবে। ছবিটি AI দ্বারা নির্মিত। আইডিয়াঃ (লেখক) সাওয়াবুল্লাহ্ হক।

তাই যতদিন না পর্যন্ত মানুষের ঘরে কালাচের আগমণের নির্দিষ্ট তথ্য বের হয়ে না আসছে ততদিন পর্যন্ত আমাদেরকে যথাসম্ভব এরকমভাবে নিজেদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে।

 

ঘরে সাপ আসা নিয়ে সংশ্লিষ্ট আরেকটি প্রবন্ধ পড়তে ক্লিক করুনঃ

সাপ তাড়ানোতে কার্বলিক এসিড কি আসলেই কার্যকর নাকি কলোনিয়াল অন্ধ অনুসরণ

ii BBC Natural World; One Million Snake Bites; 38:33-38:56.

iv The Night; My Husband and Other Animals 2 by Janaki lenin ; Page No. 283.

v Khaire, N. (2014). Indian snakes: A field guide. Jyotsna Prakasan.

viii জানাকি এখানে যে গবেষণার কথা উল্লেখ করেছে সেরকম কোন গবেষণার খোঁজ আমরা নেট দুনিয়াতে পাই নি। হতে পারে এটা কোন পাইলট স্ট্যাডি বা এরকম কোন গবেষণা যা হয়তবা কোন জার্নালের আগাম কোন সংখ্যায় প্রকাশিত হবে। যেহেতু জানাকির হাজবেন্ড রম একজন স্বনামধন্য ভারতীয় হার্পিটোলজিস্ট। এবং এই বইটিও রমের ভাষ্য নিয়েই লেখা তাই এই তথ্যের অবশ্যই কোন ভিত্তি রয়েছে। ভবিষ্যতে যদি কোন রেফারেন্স জানাকি লেনিনের সাথে যোগাযোগ করে সংগ্রহ করতে পারি সেক্ষেত্রে আমরা তা এখানে উল্লেখ করে দিব।

 

ix The Night; My Husband and Other Animals 2 by Janaki lenin ; Page No. 288.

x Khaire, N. (2014). Indian snakes: A field guide. Jyotsna Prakasan.

xiমেইলের কপিটি আমার নিকট সংরক্ষিত রয়েছে কেউ দেখতে চাইলে তা আমার পক্ষে দেখানো সম্ভব।

xii Opportunistic Observations of climbing behaviour and arboreality in Australian terrestrial elapid snakes (Elapidae: Hydrophiinae); Published on Herpetology Notes, volume 14: 1407-1415 (2021) (published online on 17 December 2021); https://scholar.google.com.au/scholar?hl=en&as_sdt=0%2C5&q=Herpetology+notes+Sleeth+climbing+elapids&oq=herpe

One thought on “কালাচের নীরব ঘাতক হওয়ার পিছনে যত কারণ , বিস্তারিত প্রবন্ধ

  1. Omar

    It’s a significant writing.
    I think you should send it to daily news paper.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.