মাদারীপুর থেকে সিলেট , সিলেট থেকে কেরালা

মাদারীপুর থেকে সিলেট , সিলেট থেকে কেরালা

Spread the love

আজ বন্য পশু হত্যা করা যেন উৎসবে পরিণত হয়েছে। মানুষ বারবার পৈচাশিকভাবে জানান দিচ্ছে এই পৃথিবীতে আবাস গড়ার একমাত্র অধিকার তারই। এজন্য মেরে পিটিয়ে, বিষ দিয়ে যেভাবে হোক সবাইকে তাড়িয়ে একমাত্র আমাদেরই আবাস গড়তে হবে। যে শ্রেষ্ঠ জাতি অন্য জাতির নিরাপত্তা দিতে পারে না সে জাতির পক্ষে নিজ স্বজাতির প্রতিও ন্যায় বিচার করা সম্ভব হয় না। এই পশুত্বের আচরণ দিন কে দিন বেড়েই চলছে। এই পশুত্বের আচরণ এখন আর নির্দিষ্ট কোন দেশকেন্দ্রিক নয়। বরং সারা বিশ্ব জুড়েই যেন পশুদের প্রতি নির্মমতা বেড়ে গিয়েছে। বিশেষ করে নিজ দেশ বাংলাদেশে যেন রীতিমত উৎসব চলছে। আমি এই আর্টিকেল যে শিরোনাম দিয়ে লিখতে শুরু করেছি সেই শিরোনাম পরিবর্তন হয়ে যাবে যদি প্রতিটা এলাকার নাম শিরোনামে তুলে ধরি। আমি ভেবেছিলাম এই মাসে কেরালার ঘটনাই হয়তবা কোন দুঃখজনক শেষ ঘটনা হবে । কিন্ত তা হয় নি।  ইতোমধ্যে উৎফুল্ল এক দল জনতার ছবি ভাইরাল হয়ে আসে ফেইসবুকের বিভিন্ন পেইজে যেখানে দেখা যায় কিছু যুবক এক মেছোবাঘ কে নির্দয়ভাবে হত্যা করে সাহসিকতার সাথে পোজ দেয়। তাদের সবার মুখেই লেগে ছিল রক্ত লাগা হাসি। আর করুণ বেদনাময় চেহারা ছিল একমাত্র মেছোবাঘটির। মেছোবাঘের বাম চোখে লেগে ছিল লাল রক্ত। আর নাক মুখ দিয়ে বেড়িয়ে আসছিল ঘন লাল রক্ত। এ এক নির্দয় চেহারা। এরা ছিল বিকৃত ধারার খুনি নয়তো তারা কখনোই এ হত্যার ছবি ফেইসবুকে পোস্ট দিত না। এ ঘটনা ঘটে চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার কাথরিয়া ইউনিয়নে।

এর আগে মে মাসের শেষ দিকেই বগুড়ার  শাহজাহানপুর উপজেলা হতে গন্ধগোকুলের চারটি ছানা উদ্ধার করা হয়। চার ছানার মাকে প্রথমেই মেরে ফেলা হয় । পড়ে উদ্ধারকারী টিম এসে বাচ্চা চারটিকে উদ্ধার করে।

এই চার ছানার উদ্ধারে প্রথমে নামেন বগুড়ার বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা এবং ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার তৌহিদ পারভেজ বিপ্লব। তিনি স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় বাচ্চাগুলোকে উদ্ধার করেন। বাচ্চাগুলোকে বর্তমানে বগুড়ার এক পরিবেশবাদী সংগঠন “তীর” এর কাছে হস্তান্তর করা হয় [১]।  ভাগ্যিস এবার আর মৃত গন্ধগোকুলের ছবি ভাইরাল হয় নি।

সবথেকে লোমহর্ষক ঘটনা ঘটে সিলেটে। সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নের বালিপাড়া গ্রামে নয়টি বন্য প্রাণীকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে এ প্রাণীরা লোকালয়ে প্রবেশ করে। আশ্রয় নেওয়া প্রাণীরা ছিল ছয়টি শিয়াল, দুইটি গন্ধগোকুল এবং একটি বেজি। আশ্চর্য ব্যাপার হল এলাকাবাসী কিন্ত এই প্রাণীদের জীবিতই আটক করে। তাদের সুযোগ ছিল বন বিভাগে বা স্থানীয় বন কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করে এই প্রাণীদের পূর্বের অবস্থান বা নিরাপদ কোন স্থানে স্থানান্তরিত করার। কিন্ত তা না করে এক রকম আক্রোশ মিটানো হয়েছে এই প্রাণীগুলোর উপর। এই ব্যাপারে মামলা করা হয়। মামলার অগ্রগতি হিসেবে কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কিনা তা এখনো জানা যায় নি। অভিযোগ পত্রে বাঘডাসা দুটোকে মেছোবাঘ লেখা হয়েছে। এই বিষয়টাও আমাকে ভাবিয়েছে। এটা কি ইচ্ছাকৃত ভুল নাকি অনিচ্ছাকৃত ভুল তা আমার বুঝে আসল না। যেটাই হোক এই প্রাণীরা যে সংশ্লিষ্ট বিভাগের নিকটেও ধীরে ধীরে অবহেলার পাত্র হচ্ছে তার এক প্রমাণ হতে পারে হয়তবা।  এলাকাবাসীর এই লোমহর্ষক ঘটনা প্রায় প্রতিটি পত্রিকাতেই চলে আসে। একবার চিন্তা করুন, গ্রামবাসীরা যদি প্রাণীগুলোকে উদ্ধার করে বন বিভাগের নিকট হস্তান্তর করত তাহলে হয়তবা ভিন্ন এবং আনন্দের খবর প্রচার হতে পারত। কিন্ত কেন আমরা এরকম দিনকে দিন হিংস্র হয়ে উঠছি।

কেরালার ঘটনা আরো দুঃখজনক। কেরালার ঘটনার পর বন্যপ্রাণীর সাথে মানুষের ব্যবহারের এক অন্ধকার দিকও প্রকাশ্যে আসে। বাজি ভরা আনারস খেয়ে কেরালার এক হাতির চোয়াল উড়ে যায়। কষ্ট এবং ব্যাথার কারণে টানা তিনদিন সে পানিতে দাঁড়িয়ে থাকে। অবশেষে সে মারা যায় । পোস্টমর্টেম রিপোর্টে দেখা যায় যে এই হাতিটি গর্ভবতী ছিল। এখন কথা হল এই বাজি ভর্তি আনারস কি উদ্দেশ্যে বানানো হয়। বলা হয় যে, বন্য শুয়োর তাড়ানোর জন্য এই পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। কেরালাতে বন্য শুয়োর দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা অনেক সাধারণ এক ব্যাপার। এবং অনেকে বন্য শুয়োরের হামলাতে মারাও যায়। এই বন্য শুয়োর তাড়ানোর এই পদ্ধতি কি নিষ্ঠুরতম পদ্ধতি নয় ? বন্য শুয়োরের চোয়ালও তো ভেঙ্গে যায়। এবং তাকে এক কষ্টকর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এই নিষ্টুরতারই নির্মম শিকার হল কেরালার এই হাতি। অবশ্যই এরকম নির্মম পদ্ধতি নিয়ে কেরালার বন বিভাগের ভাবা উচিত। কোন প্রাণীই এরকম নিষ্ঠুরতার নির্মম শিকার হতে পারে না। আর হাতির জন্য আলাদার সুরক্ষার প্রয়োজন। হাতি পৃথিবীর অন্যতম এক বিপন্ন প্রাণী। সারা বিশ্বেই হাতি তার আবাসস্থল হারানোর কারণে ক্রমান্বয়ে অস্তিত্ব হারাচ্ছে। ২০১৭ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতে এখন সাতাশ হাজার তিনশ বারটি হাতি আছে। ২০০৯-১০ থেকে ১৬-১৭ পর্যন্ত গড়ে আশিটি হাতি মারা গিয়েছে। এর মধ্যে  চোরা শিকারির হাতে একশত একটি, বিষক্রিয়ায় চুয়াল্লিশটি , বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে তিনশত নব্বইটি, এবং ট্রেনের ধাক্কায় একশত বিশটি। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে এখানে হাতিদের মৃত্যুর পিছনে মানুষই দায়ী। এখন যদি পরে থাকা বাজিভর্তি আনারস খেয়ে হাতি মারা যেতে আরম্ভ করে তাহলে নিঃসন্দেহে হাতি মৃত্যুর পিছনে আরেকটি কারণ যোগ হবে। আর সেটাও মানবসৃষ্ট।

এই আর্টিকেল লিখতে লিখতে আরো কিছু প্রাণীকে পিটিয়ে মারার খবর ফেইসবুকে ভাইরাল হয়। এদের মধ্যে বেশিরভাগই হল বন বিড়াল, মেছো বাঘ এবং গন্ধ গোকুল বা খাটাশ। আমাদের মনে রাখা উচিত একসময় বাংলাদেশের প্রতিটা অঞ্চলে এদের সড়ব উপস্থিতি ছিল। কিন্ত মানুষের আক্রোশের কারণে এরা বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল হতেই বিলুপ্ত হয়েছে। তারপরেও এরা মানুষের নির্মম ব্যবহার সহ্য করেও নিজেদেরকে গা ঢাকা রেখে টিকিয়ে রাখছে। এ যুগে মানুষের মত দয়া মায়াহীন জীব থেকে যে প্রাণী লুকিয়ে থাকে তারা তো গ্রেট সারভাইভার। 

 

তথ্যের সূত্রঃ

[১] প্রথম আলো পত্রিকাঃ https://bit.ly/3enh7Xm

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.