মাদারীপুরে বানর হত্যা করা নিয়ে নিন্দাসূচক বক্তব্য
মাদারীপুরে বানর হত্যা খুবই মর্মান্তিক ঘটনা। বানরকে কে বা কারা বিষ খাইয়ে হত্যা করে তাদেরকে এখনো চিহ্নিত করা সম্ভব হয় নি। পনেরটি বানর মারা যায়।গুগলে যদি মাদারীপুর প্লাস বানর লিখে সার্চ দেওয়া হয় তাহলে বানর সংক্রান্ত যে খবরগুলো পাবেন তারমধ্যে অন্যতম হল ‘খাদ্য সঙ্কটে মাদারীপুরের বানর’। মাদারীপুরের বানরদের খাদ্য সঙ্কট নতুন কোন তথ্য নয়। সরকার থেকে বানরের জন্য নির্ধারিত খাবারের কর্মসূচি নির্ধারণ করা হলেও বরাবরই এ নিয়ে দূর্ণীতি হয়ে আসছে। বানর নিয়মিত খাবারও পায় না। মাদারীপুরের চরমুগুরিয়া এলাকাতে আগে এক সময় বন ছিল সেই বনেই মূলত বানরের আদি নিবাস ছিল। কিন্ত বন লোপ পেয়ে মানুষের আবাস গড়ে উঠলেও বানরেরা এখানে থেকে যায়। বানরের অ্যাডাপ্টিবিলিটির কারণে সে মানুষের পাশে নিজেকে শত বছর ধরে মানিয়ে নিয়েছে। চরমুগুরিয়ার লোকজনও বিষয়টাকে স্বভাবিকভাবেই মেনে নিয়েছে বা একে বন্য সহনশীল প্রতিবেশী হিসেবে মেনে নেওয়া হয়েছে। কিন্ত খাদ্যের সঙ্কট যখন চরমে পৌছায় তখন এই বানরেরা তাদের প্রতিবেশী স্থানীয়দের নিকট বিভিন্নভাবে বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এখানে উচিত ছিল সরকারের তরফ থেকে পারস্পরিক সহযোগিতার হাত উন্মোচন করা। বানর কে ব্যক্তিগতভাবে সহযোগিতার থেকে কমিউনিটি বেইস সহযোগিতা করা বেশি জরুরি ছিল। আর সরকারের তরফ থেকে নির্ধারিত খাদ্য বানরের জন্য যথেষ্ট কিনা সে খোজ খবর নেওয়াটাও বনবিভাগের দায়িত্ব।
মাদারীপুরের বানর আরবান ওয়াইল্ডলাইফ বা শহুরে ওয়াইল্ডলাইফের অংশ। বনভূমি নির্ধারিত হারে ধ্বংস হয়ে যাওয়াতে পৃথিবীর উন্নত রাষ্ট্রসমূহ আরবান ওয়াইল্ডলাইফের দিকে ঝুঁকছে। কেননা বাস্তসংস্থান কে টিকিয়ে রাখাটা মানুষের অস্তিত্বের জন্যই জরুরি। সহজ একটা উদাহরণ দেই, ধরুন মাদারীপুর বানর মাদারীপুরের লোকদের ক্ষতি করছে (সেটা যে কারণেই হোক) এখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হল মানুষকে এই ক্ষতি থেকে রক্ষা করার জন্য সব বানর মেরে ফেলতে হবে। এভাবে যে গ্রামে বা শহরের লোকদের কে শিয়াল ক্ষতি করে তারা সিদ্ধান্ত নিল সব শিয়ালদের হত্যা করে ফেলতে হবে এবং তারা করল। এরপর এভাবে গুইসাপ, তারপর বেজি, তারপর যেখানে পাখিরা শস্য খেয়ে ফেলে সেখানকার লোকেরা পাখি ধ্বংস করার পদক্ষেপ নিল। আরেকটু গ্লোবালি চিন্তা করি বিষয়টা। কর্ণাটকের ওয়েস্ট ঘাটের বাসিন্দাদের গবাদি পশু বাঘ খেয়ে ফেলার জন্য তারা সিদ্ধান্ত নিল সব বাঘ মেরে ফেলা হবে, রাজস্থানের লোকেরা তাদের গবাদি পশু কে রক্ষার জন্য সিদ্ধান্ত নিল আশেপাশের সব হায়েনা, নেকড়ে, লেওপার্ড কে মেরে ফেলতে হবে। হিমালয়ের স্নো লেওপার্ডও তীব্র শীতে খাদ্য হিসেবে স্থানীয়দের গবাদি পশু কে বেছে নেয় এখন তারাও যদি এই আপাত ক্ষতি থেকে বাচার জন্য সিদ্ধান্ত নেয় এই স্নো লেওপার্ড কে মেরে ফেলতে হবে। তাহলে একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবুন দুনিয়াতে এরকম করে শুধুমাত্র মানুষ ছাড়া শেষ পর্যন্ত কিইবা টিকে থাকতে পারবে। ক্রমবর্ধমান মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে পৃথিবীর অসংখ্য স্থানে নিয়মিতভাবে বন্য প্রাণীর সাথে মানুষের সখ্যতা গড়ে উঠছে। মানুষ তার নিজের সুবিধার দিকে তাকিয়ে এই সখ্যতা সৃষ্টিকারী প্রাণীদের নিয়মিতহারে হত্যা করে চলেছে। মানুষ স্বার্থপরতার মত নিজ সুবিধাটাকেই দেখেছে। তারা লোকালয়ের সংস্পর্শে থাকা জীবদের যেমন বিলুপ্তির সম্মখীন করাচ্ছে ঠিক বনে গিয়েও জীব জন্ত ধ্বংস করে ফেলছে। অ্যান্টার্কটিকাতে মানুষ তিমি শিকার করতে করতে এক সময় তা বিলুপ্তির দৌড় গোড়ায় পৌছে দেয়। অর্থাৎ মানুষ শুধুমাত্র তার সংস্পর্শে আসা জীবদেরকেই হত্যা করে ব্যাপারটা এরকম নয়। মানুষ তার স্বার্থ কে সামনে রেখে রিমোট থেকে রিমোট বনের জীবকেও নিয়মিতভাবে শিকার করে আসছে। কে বলবে একদা সুন্দরবনের মত সোয়াম্প ফরেস্টে গন্ডারের বসবাস ছিল। নির্লজ্জ মানুষই বনের ভিতর থেকে এক তৃণভোজী জীবকে বিলুপ্ত করে দিয়েছে। একইভাবে এই দেশ হতে হায়েনা, নেকড়ে, ঢোল নামক বন্য কুকুওরকেও বিলুপ্ত করে দেওয়া হয়েছে। সবই করা হয়েছে মানুষের স্বার্থ কে সামনে রেখে।
এখন যে সমস্ত বন্য প্রাণীরা মানুষের পাশাপাশি থেকে টিকে থাকার সর্বচ্চ ক্ষমতা গ্রহণ করতে পেরেছে তাদেরকেও হত্যা করা শুরু করেছে। এগুলো ভালো কোন ইঙ্গিত নয়। আজ বানর হত্যা করা হবে বিষ দিয়ে আগামিকাল কাঠবিড়ালি হত্যা করা হবে। পরশু মেছোবাঘ হত্যা করা হবে। অবশেষে আপনার সন্তানদেরকে কোন প্রাণীটার সাথে পরিচয় করাতে পারবেন। বাস্তসংস্থানের নিয়মভিত্তিক সার্কেল ভিত্তিক চেইন কি আদৌ টিকে থাকতে পারবে? আমি আপনি প্রকৃতির ছোয়ায় কি আদৌ থাকতে পারব? নাকি কৃত্তিমতাই আমাদের ভবিষ্যৎ উদ্দেশ্য হতে চলেছে।
এরকম ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড থামানোর জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া খুবই জরুরী।
১. মানুষকে অবশ্যই সহনশীল হতে হবে।
২. আধুনিক কনজারভেশন সিস্টেম ফলো করতে হবে যাতে করে মানুষ এবং বানর পাশাপাশি থেকে একে অপরের মধ্যকার ক্ষতি কমিয়ে এমনভাবে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে যাতে করে উভয়ই লাভবান হতে পারে।
৩. মাদারীপুরের চরমুগুরিয়া অঞ্চলের বনভূমি উজাড় হওয়ার কারণে এখানকার বানরেরা বন্য প্রাণী হলেও তারা খাদ্যের ব্যাপারে পুরোপুরি মানুষের উপর নির্ভরশীল এই বাস্তবতা বুঝতে হবে। এজন্য কমিউনিটি বেইজ খাদ্যের ব্যবস্থা করতে হবে।
৪. জুলজিস্ট, ন্যাচারালিস্ট, কনজারভেশন এক্সপার্টদের সাথে আলোচনা করে অত্র অঞ্চলে ইকোপার্কের ব্যবস্থা করতে হবে। যেখানে বানরের জন্য প্রাকৃতিকভাবে খাদ্যের উৎসের ব্যবস্থা থাকবে এবং এর পাশাপাশি ইকোপার্কে স্থানীয় জীব জন্তদের যেমনঃ গুই সাপ, বন বিড়াল, মেছোবাঘ, বেজি ইত্যাদি প্রাণীর অভয়ারণ্য গড়ে সেখানে দর্শনার্থীদের আগমনের ব্যবস্থা থাকতে হবে যারা নির্দিষ্ট দূরত্বে থেকে মাদারীপুরের জীববৈচিত্র্যের ব্যাপারে জানতে পারবে।
৫. শহুরে ওয়াইল্ড লাইফ কে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। যেখানে আরবান ওয়াইল্ড লাইফের নানাদিক উল্লেখ করা হবে।
৬. চরমুগুরিয়ার বানরদের জন্য সরকারের যে আলাদা অর্থায়ন রয়েছে তার নিশ্চিত ব্যবহারের জন্য তদারকির ব্যবস্থা রাখতে হবে।
এই ছয়টি পদক্ষেপের পাশাপাশি এ সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে আইন কার্যকার করাটাও জরুরি। তবে স্থানীয় জনগনের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করতে না পারলে আইন দ্বারা তা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নাও হতে পারে।
তবে এ বিষয়টা স্পষ্ট হওয়া দরকার মাদারীপুরের বানরেরা মূলত macaques প্রজাতির। এ বানরেরা বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলেও মানুষের সংস্পর্শে রয়েছে। এছাড়া ভারত, নেপাল, ভুটান, থাইল্যান্ড সহ পৃথিবীর অনেক দেশে এরা মানুষের পাশে নিজেদের রাজত্ব বানিয়ে নিয়েছে। এমনকি ইউরোপের একমাত্র ওয়াইল্ড প্রাইমেট হচ্ছে এই ম্যাকাকস বানর। তারাও শহরে বসবাস করছে। এই বানরের মানিয়ে নিয়ে থাকার ক্ষমতা অত্যন্ত শক্তিশালী হওয়ার কারণে তাদের বন্য বৈশিষ্ঠ্য কে অক্ষুণ্ণ রেখে সুন্দরবন, কাজিরাঙ্গা, কর্ণাটকের গভীর বনে যেমন টিকে রয়েছে তদ্রুপ মানুষের পাশে থাকার ক্ষমতাও তাদের রয়েছে। অন্যান্য অনেক বন্য প্রাণীর মত এই বানরও কিছু ভাইরাস বহন করে থাকে যা এই বানরের কোন ক্ষতি না করলেও এর সংস্পর্শে আসা মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাড়াতে পারে। যেমনঃ এদের থেকে হার্পেস বি ভাইরাস ছড়ায় [২]। যা মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে। তাই এর বন্য বৈশিষ্ট্য কে অক্ষুন্ন রাখা আমার আপনার সকলের কর্তব্য। অর্থাৎ একে পেট এনিম্যাল হিসেবে এর সংস্পর্শে আসা সম্ভব নয়। তাই একে রক্ষার পাশাপাশি এর সাথে দূরত্ব রক্ষা করার বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। স্থানীয়দের বাড়ি ঘরের কাঠামো এজন্য কিরকম হওয়া উচিত তাও সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনা করতে হবে। পাহাড়ি অঞ্চলে হাতির আক্রমণ এবং হাতি দ্বারা ফসল নষ্ট লাঘবের জন্য ব্যপকহারে মাল্টার চাষ শুরু হয় ইতোমধ্যে ওখানকার জনগন সেই উপকার পাচ্ছে।
এখন বানরের মৃত্যু নিয়ে প্রথম আলোর করা রিপোর্টের কিছু অংশ তুলে ধরে আমার লেখাটি শেষ করছি।
“যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে মারা গেল বানরগুলো”
‘মাদারীপুরে বানরের উৎপাতে অতিষ্ঠ মানুষ। খাবারের জন্য মানুষকে বিরক্ত করে। কারও কারও বাড়িতে গিয়ে হাজির হয় বানরগুলো। এগুলোর উৎপাত থেকে রক্ষা পেতে প্রশাসন বা পুলিশের কাছে সহযোগিতা চাইতে পারতেন তাঁরা। কিন্তু তা না করে খাবারে বিষ মিশিয়ে বানরকে খেতে দিয়েছেন। ওই খাবার খেয়ে একটি বা দুটি বানর নয়, অন্তত ১৫টি বানর মারা গেছে। গতকাল মঙ্গলবার এই মর্মান্তিক ঘটনাই ঘটেছে মাদারীপুর পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যখাগদী এলাকায়।’ [২]
পোস্ট আপডেটঃ এই পোস্টটি লেখা হয় বানরগুলোকে যেদিন হত্যা করা হয় অর্থাৎ পাঁচই মে দিবাগত রাতে। বানর হত্যার সাথে জড়িত হওয়ার অভিযোগে গত দশই মে এক নারীকে আটক করা হয়। পুলিশের বিবৃতি অনুযায়ী অভিযুক্ত আসামি বানরের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে খাবারে বিষ প্রয়োগের কথা স্বীকার করেন ।[৩]
প্রয়োজনীয় লিঙ্কসমূহঃ
.
১. https://www.cdc.gov/herpesbvirus/transmission.html
.
২. প্রথম আলোর লিঙ্কঃ https://bit.ly/2YG4IJ5
৩. বাংলা ট্রিবিউনের লিঙ্কঃ https://bit.ly/3e3Rpa9
[…] […]