চরমুগুরিয়া ইকোপার্কের কাজ শেষ হতে আরো কতদিন ?

চরমুগুরিয়া ইকোপার্কের কাজ শেষ হতে আরো কতদিন ?

Spread the love

 

মাদারীপুরের ছেলে হিসেবে এটা আমার জন্য সৌভাগ্যের বিষয় যে এখানে একটা ইকোপার্ক বানানো হচ্ছে। গত কয়েক বছর আগেই এর বানানোর খবর আমি জানতে পারি। ইকোপার্কের বর্তমান পরিস্থিতি বুঝার জন্য গত পহেলা অগস্ট আমি সরেজমিনে ঘুরে আসি। আমার অভিজ্ঞতাই এখানে বয়ান করব।

প্রথম কথা হল, ইকোপার্ক কি ? বাংলাপিডিয়াতে ইকোপার্কের ব্যাপারে যা বলা হয়েছে তা হল,

“ইকোপার্ক স্থাপনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে: হুমকির সম্মুখীন ও বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদ প্রজাতির সংরক্ষণ ও উন্নয়ন, বিবিধ দুর্লভ প্রজাতির বৃক্ষরোপণ ও সংরক্ষণ, বিদ্যমান উদ্ভিদ ও প্রাণিবেচিত্র্য সংরক্ষণ ও উন্নয়ন, নিবিড় ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দেশিয় প্রজাতির গাছের বংশভান্ডার তৈরি ও উন্নয়ন, পরিবেশ সংরক্ষণ ও স্থানীয় জনসাধারণের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন, পরিকল্পিত ইকো-ট্যুরিজম শিল্পের প্রসার, শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি”।[১]

অর্থাৎ ইকোপার্কের উদ্দেশ্য নানামুখী। সহজ ভাষাতে ইকোপার্ক হল এমন কোন পার্ক যেখানে স্থানীয় প্রাণী এবং উদ্ভিদের অভয়াশ্রম গড়ে উঠবে এবং যা দ্বারা স্থানীয় মানুষের প্রাকৃতিক বিনোদনের চাহিদা মিটবে এবং স্থানীয় জনগণ আর্থিকভাবে উপকৃত হবে। এর পাশাপাশি ইকোপার্ক বিভিন্ন আঞ্চলিক এবং জাতীয়ভাবে বিভিন্ন গবেষণার কাজে ব্যবহৃত হবে।

সে হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলাতে ইকোপার্কের প্রয়োজন। কেননা মানুষের জনবসতি ক্রমান্বয়ে বাড়ানোর ফলে অনেক জীব জন্তরই আবাসস্থল চরমপর্যায়ে  হুমকির সম্মখীন হয়ে পড়ছে। মাদারীপুরে ইকোপার্ক তৈরি করার অন্যতম কারণ হল এর স্থানীয় বানর। মূলত স্থানীয় বানরদের সংরক্ষণের উদ্দেশ্য কে সামনে রেখেই এই ইকোপার্ক প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়। দিন যত যাচ্ছে তত স্থানীয় নাগরিকদের সাথে বানরদের মধ্যে বৈরিতা বাড়ছে। এছাড়াও ইকোপার্কটি যদি সফল হয় তাহলে স্থানীয় নানা প্রাণী যা মাদারীপুরের বিভিন্ন থানা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে উদ্ধার করা হয় সেসব প্রাণীদেরও এক নিরাপদ আবাসস্থল হিসেবে গড়ে উঠার সম্ভবনা আছে।

ইকোপার্কে সরেজমিনে গিয়ে যা দেখলাম তাহল বানর সংরক্ষনের উদ্দেশ্যে ইকোপার্কটি স্থাপন করা হলেও ইকোপার্কটি এখনো প্রস্তত নয়। প্রস্তত তো নয়ই বরং প্রস্ততের ধারেকাছেও নেই। ২৩ জুন ২০১৪ তে এর ভিত্তিপ্রস্তর উদ্ভোধন করা হলেও আজ ছয় বছর অতিক্রম হয়ে গেলেও এর পুরো কাঠামো এখনো তৈরিই হয়নি।

প্রায় সতের একর জমির ইকোপার্কটির সীমানাও পুরোপুরি চিহ্নিত করা হয় নি। বর্ষা মৌসুমে ইকোপার্কটির সত্তর পার্সেন্ট এরিয়ায় পানির নিচে ঢাকা পড়ে থাকে। অর্থাৎ নিম্ন ভূমি এখন পর্যন্ত ইকোপার্কের জন্য উপযুক্ত করে উঁচু করা হয়নি।

বানর এবং অন্যান্য বন্যপ্রানীর জন্য উপযুক্ত হাতে গোনা চার পাঁচটা উদ্ভিদ লাগানো হয়েছে মাত্র। আর আগে থেকেই থাকা বিভিন্ন ইনভেসিভ বা বাহিরের প্রজাতির উদ্ভিদ যা ছিল তার একটাও কাটা হয়নি।  মেহগনি গাছের বাগান পরিষ্কার করা হয়নি। কিন্ত বানরের আবাস উপযোগী বানাতে হলে এই গাছ কেটে অবশ্যই দেশি এবং ফলজ উদ্ভিদের চারা রোপন করতে হবে। কিন্ত ইকোপার্কটি ঘুরে যা বুঝলাম সে ব্যাপারে কাজ ফাইল পর্যন্তই রয়ে গিয়েছে ।

ইকোপার্কের ভিতরে এখনো কে বা কারা যেন মেচতা (ধইঞ্চার) চাষ করছে। দেয়ালগুলো খুবই নিচু যা বন্যপ্রাণীদের সংরক্ষণ করতে সম্ভব নয়। পুরো দেয়ালও তোলা হয়নি এখনো। এখনও স্থানীয় মানুষদের বসতির সাথে ইকোপার্কের মধ্যে যাতায়াতের ব্যবস্থা রয়ে গিয়েছে।

পার্কটির বিভিন্ন স্থাপনা তে শ্যাওলার আস্তরণ পড়ে গিয়েছে। পার্কটির নিরাপত্তার জন্য কোন ব্যবস্থা এখনো গ্রহণ করা হয় নি। কোন গার্ড বা কর্মী পাওয়া যায়নি। কোন ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরাও পাওয়া যায়নি। এছাড়াও স্থানীয় মানুষদের অবাধ বিচরণ রয়েছে পার্কটিতে। ইকোপার্কের ভিতরের পুকুরের পানি ব্যবহারের জন্য নিষেধ করে সাইনবোর্ড টানানো হলেও তা কার্যকর নয়।

ইকোপার্কেই অ্যাডমিনিস্ট্রেশন লেভেলের কাজের জন্য নেই কোন অফিস বা ভবন। শিক্ষা সফরে আসা শিক্ষার্থীদের জন্য বানানো হয়নি আলাদা কোন ভবন অথবা গবেষণার জন্যও তৈরি করা হয়নি এখন পর্যন্ত আলাদা কোন ভবন। ইকোপার্কের পুকুরে কি আছে তা জানা সম্ভব হয়নি কেননা  এ ব্যাপারে কোন সাইনবোর্ডও টাঙ্গানো হয় নি। ইকোপার্কে রয়েছে বানরের খাবার দেওয়ার জন্য দোতালা একটা আবাসন গড়া হলেও সেখানে  প্রায় কোমড় সমান পানিতে  ভিজে পৌছাতে হবে। এছাড়াও মানুষের দৃষ্টি জুড়ানোর জন্য যে ওয়াচ টাওয়ার স্থাপন করা হয়েছে সেই ওয়াচ টাওয়ারে পৌছাতেও কোমড় থেকে গলা পরিমাণ পানিতে নামা লাগবে। অর্থাৎ চরমুগুরিয়া ইকোপার্কটি কোন দিক থেকেই কোন প্রাণী সংরক্ষণের জন্যই এখন পর্যন্ত প্রস্তত নয়। যদি অবকাঠামোগত বিভিন্ন ভবনের কথা বাদ দিয়ে শুধুমাত্র বৃক্ষ রোপন এবং তার পরিচর্যা সমেত বড় করা পর্যন্ত সময় নেওয়া হয় তাহলে প্রায় ছয় থেকে আট বছর সময় লাগবে।

কিন্ত গাছ রোপন করা তো দূরের কথা গাছ রোপনের বিভিন্ন পরিকল্পনাই এখন পর্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে রয়েছে। যার কোন সমাধান এখন পর্যন্ত বনবিভাগ দিতে পারেনি। অক্টোবর ০৪, ২০১৯ এর বণিক বার্তা-র এক রিপোর্টে বলা হয় , “একটি ফলের চারা লাগাতে সাধারণত তিন মিটার বাই তিন মিটার জমি প্রয়োজন হয়।সে হিসাবে প্রতি কাঠা জমিতে সর্বোচ্চ ১৬টিগাছ লাগানো সম্ভব। তবে ফলের গাছের সঙ্গে শোভাবর্ধনকারী গাছের চারা লাগালে এ সংখ্যা সর্বোচ্চ ২৫টিতে উন্নীত করা যায়।অথচ বন অধিদপ্তরের এক প্রকল্পে প্রতিকাঠায় প্রায় ৬২০টি গাছ লাগানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। আর এসব গাছ লাগাতে ব্যয় হবে ১০ কোটি ৯৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা”। রিপোর্টে আরো বলা হয়, “পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্প এলাকার মোট আয়তন ১৭ দশমিক ৯৭ একর। এর মধ্যে প্রায় দুই একর আয়তনের পুকুর রয়েছে। তাছাড়া প্রকল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো ও স্থাপনা নির্মাণ করা হবে। ফলে বনায়নের জন্য সর্বোচ্চ ১৫ একর বা ৯০৯ কাঠা জমি অবশিষ্ট থাকবে। এতটুকু জমিতেই লাগানো হবে ৫ লাখ ৬৪ হাজার ফলদ, বনজ ও শোভাবর্ধনকারী বৃক্ষের চারা। সে হিসাবে প্রতি কাঠায় ৬০০টির বেশি গাছ লাগাতে হবে।

অস্বাভাবিক ঘনত্বে গাছ লাগানোর পরিকল্পনাসংবলিত এ প্রকল্প সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কীভাবে অনুমোদন দিয়েছে, তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) সাবেক কান্ট্রি ডিরেক্টর ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, আমার জানামতে, প্রতি হেক্টরে বনজ গাছ লাগানো যায় ২ হাজার ২০০ থেকে সর্বোচ্চ আড়াই হাজার। আর শোভাবর্ধনকারী গাছ লাগানো হলে গাছের সংখ্যা সর্বোচ্চ দ্বিগুণ হতে পারে। আবার ফলের গাছ লাগালে সংখ্যাটা আরো কমে আসবে। স্বল্প জমিতে এত বেশি গাছ লাগানোর কোনো উপায় আমার জানা নেই। যদিও প্রকল্পটির বিষয়ে বিস্তারিত জানি না। তবে এ ধরনের কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের পরিকল্পনা যদি থেকে থাকে, তবে তা হবে অস্বাভাবিক”[২]।

এই প্রশ্নবিদ্ধ পরিকল্পনাতে ইকোপার্ক কতটুকুই বা ইকোফ্রেন্ডলি হতে পারবে। ইকোপার্কের পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারীদের  প্রতি একজন প্রকৃতি প্রমিক হিসেবে যে আবদারসমূহ রাখছি তাহল,

অচিরেই ইকোপার্কটিকে বনায়ন শুরু করুন। উদ্ভিদবিজ্ঞানী এবং প্রাণীবিজ্ঞানীদের সাথে কথা বলে চরমুগুরিয়ার যে বানর কে এখানে আনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে তাদের খাদ্যভ্যাস কে সামনে রেখে বনায়ন শুরু করুন। বর্তমানে বানরের আবাসস্থল থেকে ইকোপার্কটির দূরত্ব মাত্র আধা কিলোমিটারেরও কম। যদি আদর্শ বনায়ন করা সম্ভব হয় আশা করা যায় বানরেরা নিজ থেকেই এখানে এসে নিজেদের স্থায়ী আবাস গড়ার সুযোগ পাবে। এই বনায়ন শুরু করার জন্য যা যা করা দরকার সেই কাজসমূহ শুরু করুন। এজন্য ভূমি উঁচু করতে হবে ব্যাপকহারে। কেননা ইকোপার্কের পুরো ভূমিটাই একটা জলা এবং নিচুভূমি। আমার মনে হয় এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পরিকল্পনা রয়েছে।

এই ইকোপার্ক বানর সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে করা হলেও আমাদের স্থানীয় অন্যান্য প্রাণীর ব্যাপারেও এখানে মনোযোগী হওয়া দরকার। কেননা, স্থানীয় বিভিন্ন সরীসৃপ, পাখি , স্তন্যপায়ী প্রাণী সবার জীবনই হুমকির সম্মখীন। স্থানীয়ভাবে মাদারীপুরে বড় কোন বন জঙ্গল না থাকলেও মাঝমধ্যেই বিভিন্ন গ্রাম গঞ্জ থেকে বন্যপ্রাণী পিটিয়ে মারার খবর পাওয়া যায়। এদের মধ্যা হল, গুই সাপ, শিয়াল, বেজি, গন্ধগোকূল, মেছোবাঘ, বনবিড়াল প্রভৃতি। তাই এদের জন্যও ইকোপার্কে জায়গা রাখা উচিত হবে বলে আমি মনে করি। ইকোপার্ক সংশ্লিষ্ট পুকুরটি যেন অতিথি পাখি এবং স্থানীয় বিভিন্ন পাখিদের আনাগোনার এক অভয়ারণ্য হয়ে উঠতে পারে সেদিকটাও খেয়াল রাখার অনুরোধ থাকবে।

ইকোপার্ক সংশ্লিষ্ট কিছু কাজের প্রশংসা না করলেই নয়। মূল চরমুগুরিয়া থেকে ইকোপার্কটির দূরত্ব আধা কিলোমিটারেরও কম। মাঝপথে নদী হওয়ার কারণে এ দূরত্ব আগে পাঁচ কিলোমিটার থেকেও বেশি পথ ঘুরে আসা লাগত। কিন্ত নদীর উপর দিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে নতুন দৃষ্টিনন্দন ব্রীজ হওয়াতে এই দূরত্ব অনেক কমে গিয়েছে যা ভবিষ্যতে ইকোপার্ক ভ্রমণে সাধারণ মানুষদের উৎসাহ আনয়ন করবে।

খুব রিসেন্টলি বিষ খাইয়ে পনেরোর অধিক বানর হত্যা করার ঘটনা আশা করি সবাই জানেন। প্রাণী প্রেমী সকলের অন্তরে এ ঘটনা অনেক ক্ষতের সৃষ্টি করে। এ সংশ্লিষ্ট আমার পূর্বের লেখাটি পড়তে ক্লিক করুন এখানে। তাই কতৃপক্ষের নিকট অনুরোধ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই প্রজেক্টটি সচল করুন।

প্রয়োজনীয় তথ্যের উৎসঃ 

[১] http://bn.banglapedia.org/index.php?title=%E0%A6%87%E0%A6%95%E0%A7%8B%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%95

[২] https://bonikbarta.net/home/news_description/206737/%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A4%E0%A6%BF-%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%A0%E0%A6%BE%E0%A7%9F-%E0%A7%AC%E0%A7%A8%E0%A7%A6%E0%A6%9F%E0%A6%BF-%E0%A6%97%E0%A6%BE%E0%A6%9B-%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%97%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A7%87-%E0%A6%9A%E0%A6%BE%E0%A7%9F-%E0%A6%AC%E0%A6%A8-%E0%A6%85%E0%A6%A7%E0%A6%BF%E0%A6%A6%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%B0-

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *