দোয়েলের জন্য ভালোবাসা
দোয়েলের নাম শুনলে প্রথমে যে চিন্তা মাথায় আসে তা হল এর জাতীয় প্রতীক হওয়ার বিষয়টা। একটা পাখির এরকম কি গুরুত্ব থাকতে পারে যে এই পাখিকে জাতীয় পাখি ঘোষণা করা হল ! এর থেকেও অনেক সুন্দর সুন্দর পাখি ছিল। তাদেরকে কেন জাতীয় পাখি ঘোষণা করা হল না। এই প্রশ্নের উত্তর আমারো আসলে জানা নেই। তবে ছোটবেলাতে জানতাম ঐ জিনিসকেই কোন রাষ্ট্রের জন্য জাতীয় ঘোষণা করা হয় যা ঐ নির্দিষ্ট রাষ্ট্রের বাহিরে অন্যকোন রাষ্ট্রে পাওয়া যায় না। কিন্ত এটা একটা ভোগাস কথা ছিল। এই বক্তব্য কিছু জাতীয় প্রতীকের ব্যাপারে সঠিক হতে পারে কিন্ত অধিকাংশ জাতীয় প্রতীকের ব্যাপারেই না। দোয়েল বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীক হলেও এর বিচরণ রয়েছে ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা , পাকিস্তান ,ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, চায়না, মালোয়শিয়া এবং সিঙ্গাপুরে। অর্থাৎ ভারতীয় উপমহাদেশ এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার অনেক রাষ্ট্রেই এ পাখির বিচরণ রয়েছে।
এ পাখির মূল সৌন্দর্য হল এ পাখি হল অন্যতম এক ‘গায়ক পাখি‘ বা ‘singing bird’ । যারা দোয়েল পাখিকে খুব সাধারণ কোন পাখি ভাবেন তাদের নিকট অনুরোধ রইল তাদের কখনো যদি সুযোগ হয় তাহলে দোয়েলের ডাক শুনবেন। যা সকালে যখন সূর্য উঠে উঠে অনেক সময় দুপুরে আবার কখনো সন্ধ্যায়। ভারত উপমহাদেশের অন্যতম পক্ষীবিশারদ (Ornithologist) সালিম আলী (১৮৯৬–১৯৮৭) পাখি নিয়ে তার অন্যতম বই ‘ The Book of Indian Birds’ এ এই পাখিকে ‘One of the finest songsters’ অর্থাৎ অন্যতম গায়ক পাখি হিসেবে অভিহিত করেন i। এর সব থেকে কমন ডাক হচ্ছে অনেকটা শিষ দিয়ে একনাগাড়ে কথা বলে যাওয়ার মত। সকালের দিকে এই ধরণের ডাক দিয়ে তার বেলা শুরু হয়। অনেক সময় দেখা যায় তার ডাকের সাথে সাথে তার লেজটাকেও দাড় করিয়ে নাচায়। জার্নাল অফ অর্নিথোলজির এক প্রবন্ধে দোয়েলের গান গাওয়ার আচরণ সম্পর্কে আলোচনা করা হয় । সেখানে উল্লেখ করা হয় পুরুষ দোয়েল দু ধরণের গান গায়। একটা হল বিচ্ছিন্ন সুরে। আরেকটা হল একনাগাড়ে। বিচ্ছিন্ন বা এলোমেলো সুরে গান গাওয়া হয় সাধারণত পুরো প্রজনন সময়কাল জুড়ে । এবং তা নির্দিষ্ট সময় জুড়ে নয়। আর একনাগাড় বা এক সুরে গান গায় সাধারণত পারস্পরিক সম্পর্ক জুড়ার সময় অথবা কোন পুরুষ দোয়েল অনধিকারপ্রবেশ চর্চা ঘটালে কিংবা স্তত্রী দোয়েলের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। দোয়েল পাখি বিভিন্ন সুরে গান গায়। সব সময় যে সে একই সুর ব্যবহার করে ব্যাপারটা এরকম নয়। তারা সুর বদলাতে পারেii। আরেক গবেষণাতে উল্লেখ করা হয় যে এরা এদের গানের জন্য অসংখ্য ধরণের সুর ব্যবহার করতে পারে। চাইলে এরা একে অপরের সুর নকলও করতে পারেiii। এছাড়াও দোয়েল খুব নিখুঁতভাবে অন্যান্য পাখিদের ডাক চাইলে নকল করতে পারেiv।
বাংলাদেশে এ পাখিকে সব জায়গাতে দেখতে পাওয়া যায়। শহর,গ্রাম, বন সবজায়গাতে v। অর্থাৎ এটা এমন এক পাখি যার গান দ্বারা আপনি সব জায়গাতে বিনোদিত হতে পারবেন। এ পাখি গাছে গাছে থাকলেও তার খাদ্যের বড় একটা অংশ সে মাটি থেকে গ্রহণ করে। ঝিঁঝিঁ পোকা, ঘাসফড়িঙ, পিপড়ে, ক্যাটারপিলার এবং অন্যান্য পোকামাকড় এর মূল খাদ্য। এছাড়াও শিমুল গাছের ফুল এবং গোলাপ জাতীয় ফুল হতে মধু পান করতে দেখা যায়vi। অনেক সময় একে রাতের বেলা রাস্তার লাইটের নিচে পোকা শিকার করতে দেখা যায়। সুযোগ পেলে ছোট টিকটিকি এবং কেঁচোও শিকার করতে দেখা যায় vii । প্রজননকালে পুরুষ দোয়েল নিজেকে প্রদর্শনের কাজে ব্যস্ত রাখে। এসময় তারা বিভিন্ন কার্যক্রম দেখায়। লেজ কে দাড় করায় আবার নিচে নামায়। মাথা দিয়ে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করে। বাহিরের কোন দোয়েল চলে আসলে এরা রাগতভাব নেয় এবং লড়াই করার ইচ্ছে পোষণ করে viii।
পুরুষ দোয়েল এবং স্ত্রী দোয়েলের মধ্যকার দৃষ্টিগোচর পার্থক্য হল পুরুষ দোয়েলের পাখনা সাদার পাশাপাশি গাড় কালো এবং স্ত্রী দোয়েলের পাখনা ধূসর বা পাংশু টাইপের বাদামি হয়। আর পুরুষ এবং স্ত্রী উভয় দোয়েলেরই গাড় কালো চষ্ণু আছে।
দোয়েলের প্রজননকাল চলে মার্চ থেকে জুলাইয়ের শেষ পর্যন্ত । এবং এরা বাসা বাঁধে গাছের কোটরে বা দুই ওয়ালের মাঝখানের ফাঁকা জায়গাতে আবার অনেক সময় মানুষের বাড়ির ছাদেও এদের বাসা করতে দেখা যায়। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হওয়ার পর স্ত্রী পাখি বাচ্চাদের খাওয়ানোর কাজে মনোযোগ দান করে আর পুরুষ বাসা পাহাড়া দেয়। পুরুষ দোয়েলের আক্রমণাত্মক ভাব তাদের বাসাকে রক্ষার কাজে সহায়তা দান করে।
দোয়েলকে এক সময় আমাদের উপমহাদেশে খাচায় রাখা হত শুধুমাত্র তাদের গান শোনার জন্য। যদিও বন্যপ্রাণী সংক্রান্ত আইন পাশের কারণে আমাদের দেশের লোকেরা একে খাচাবন্দী করা ত্যাগ করলেও পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশে এখনো প্রতিনিয়ত এ পাখি চোরাকারবারিদের শিকার হচ্ছে। এ সংক্রান্ত নিবন্ধে উল্লেখ করা হয় জানুয়ারি ২০১৫–ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত চোরাকারবারিদের হাত থেকে ২৬,৯৫০ টি দোয়েল উদ্ধার করা হয়। ২০২০ সালেই মানে গত বছরে ১৭,৭৩৬ টি দোয়েল জব্দ করা হয়। যা মোট সংখ্যার ৬৬ পার্সেন্ট। অর্থাৎ এই পাখি চোরাকারবারিদের দ্বারা প্রতিনিয়ত আক্রান্ত হচ্ছে। বেশিরভাগ পাখিই শিকার করা হয় মালোয়শিয়া হতেix। একমাত্র এই দোয়েলের সুন্দর গানের জন্য এ পাখি চোরাকারবারিদের শিকার হচ্ছে। এত সুন্দর একটা পাখি যদি এরকম শিকার হতেই থাকে তাহলে IUCN এর রেড লিস্টে এর স্ট্যাটাস লিস্ট কনসার্ন হলেও অতিশীঘ্রই এই অবস্থার অবনতি হবে।
যেখানে আমাদের শহরগুলোতে গায়ক পাখির খুব অভাব সেখানে আমাদের উচিত দোয়েলের ব্যাপারে আরো বেশি ভালোবাসা দেখানো। যাতে করে আমাদের পুরো শহুরে জঙ্গলগুলো দোয়েলের গানে মুখরিত হয়ে থাকে । বিবিসির মত চ্যানেল বৃটেনের ওয়াইল্ড লাইফের সৌন্দর্য দেখানোর জন্য প্রতিবছর Autumnwatch এবং Springwatch নামে দুটো প্রোগ্রাম চালায়। সেখানে বিভিন্ন পাখিদের গান এবং নেস্টিং দেখানো হয়। আমাদেরও উচিত বিশেষ করে গ্রীষ্মে এরকম কোন প্রোগ্রাম চালু করা যেখানে পাখিদের কার্যকলাপ দেখানো হবে। যদি এরকম কোনপ্রোগ্রাম চালু করা হয় তাহলে আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি সেই প্রোগ্রামে আমাদের দোয়েল হবে সুপারস্টার এবং সুপার সিঙ্গার। দোয়েলের জন্য একরাশ ভালোবাসা রেখে এই আর্টিকেল শেষ করছি। দোয়েল হল সেই পাখি যার গান আমাদেরকে কষ্ট ভুলায় এবং মুখরিত রাখে।
i Page no. 46 ; The Book of Indian Birds by Salim Ali
ii Journal of Ornithology; January 2019; Article by Amar singh , Dinesh Bhatt & Vinayra Kumar Sethi ; Page no: 185
iii Song performance Rules in the Oriental Magpie Robine (Copsychus Salauris) from Our Nature Journal; (2007)5:1-13
iv Page no. 46 ; The Book of Indian Birds by Salim Ali
v Red List of Bangladesh Volume 3 : Birds ; Page no: 518
vi Page no. 46 ; The Book of Indian Birds by Salim Ali
viii Page no. 46 ; The Book of Indian Birds by Salim Ali
IX Traffic March 2021 edition; Smuggled For Its Song The trade In Malaysia’s Oriental Magpie Robin
দোয়েল সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে ভাল লাগল। দোয়েল আমাদের জাতীয় পাখি। আমাদের জাতীয় পাখি সম্পর্কে বিস্তারিত জানা লাগবে। দোয়েল সম্পর্কে এবং এর প্রতীক কোথায় কোথায় ব্যাবহার করা হয় তা জানতে হবে। দোয়েল সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আমাদের ওয়েবসাইট ভিজিট করুন।
ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য। আমি সাইটটি ভিজিট করব।
দারুন হয়েছে। প্রানীদের প্রতি ভালবাসা আপনার অনেক।
এমন অন্যান্য প্রানীদের প্রতিও আমাদের ভালবাসা থাকতে হবে তাহলে প্রানীরা বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পাবে।