সত্যজিৎ রায়ের ছোটগল্পে প্রকৃতির সাতকাহন (দ্বিতীয় অর্থাৎ শেষ পর্ব)
প্রথম পর্বটি পড়ুন এখানে সত্যজিৎ রায়ের ছোটগল্পে প্রকৃতির সাতকাহন (প্রথম পর্ব)
আকাঙ্খিত ব্যক্তিরা বঞ্চিত ননঃ
তবে রায় সাহেব প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য যারা আসলে আকাঙ্খিত অর্থাৎ যারা বিত্তশালী, অফিসের কর্মকর্তা গোছের কেউ অথবা মেধাবী এবং সাহসী ব্যক্তি তাদেরকেও তিনি বঞ্চিত করেন নি। তাদের জন্যও তিনি গল্পের প্লট সাজিয়েছেন ।
যেমন, ‘সেপ্টোপাসের খিদে’ নামক গল্পে এমন এক ব্যক্তিকে আনা হয়েছে যিনি বই লিখেন এবং বই লিখে তার মোটামুটি ভালোই রোজগার হয়। তাই এখানে তাঁর বক্তব্য এভাবে তুলে ধরা হয়,
‘চাকরি একটা আছে বটে , তবে আশা আছে বই থেকে তেমন রোজগার হলে চাকরি-বাকরি ছেড়ে দিয়ে কেবল লিখব , আর লেখার অবসরে দেশভ্রমণ করব।’
খুব সাধারণ এক চাওয়া। কিন্ত চাওয়াকে বাস্তবতার রূপ দেওয়া সাধারণ মানুষদের জন্য কঠিন হলেও বিত্তশালীদের জন্য অতটা কঠিন নয়। এ গল্পতেই ‘কান্তিবাবু’ নামক এক উদ্ভিদবিজ্ঞানী সম্পর্কে এক উদ্যমি ব্যক্তির সাথে পরিচয় করানো হয়। তিনিও যে একজন অবস্থাসম্পন্ন ব্যক্তি তা বর্ণনাতেই পাওয়া যায়। এককালে তিনি বটানির প্রোফেসর ছিলেন স্কটিশচার্চ কলেজে। ভদ্রলোক ছিলেন আমেরিকাতে। ফিরেছেন দু’বছর । বারাসাতে বাড়ি কিনেছেন। সেখানে বাগান আছে। গ্রিন-হাউস আছে। কান্তিবাবুর আগের বাড়িতেও একটা গ্রিন হাউস ছিল। সেখানে নানা প্রকার অর্কিড ছিল। প্রায় ষাট-পয়ষট্টি রকমের অর্কিড ছিল তার গ্রিন হাউসে।
অর্থাৎ কান্তিবাবুর শখ টিকে থাকার পিছনে যে অর্থ এক বড় সহায়ক ভূমিকা রেখেছে তা বুঝে উঠা মুশকিল নয়। অর্কিড সে যদি নিজে কিনে থাকেন তাহলেও তা অনেক টাকার ব্যাপার ঠিক তেমনি নিজে যদি বিভিন্ন বন হতে সংগ্রহ করেন সেখানে অর্থ এক মুখ্য বিষয়। অর্থাৎ এরকম প্রকৃতি নিয়ে এরকম উদ্দীপনা কান্তিবাবুকেই মানায়।
এরপরে আরেকটি গল্প ‘ বিপিন চৌধুরীর স্মৃতিভ্রম‘ নামক গল্পতে যদি দেখি সেখানে বিপিন চৌধুরী কে অবস্থাসম্পন্ন হিসেবে দেখানো হয়। বিপিন চৌধুরী কে এমনভাবে পরিচয় করানো হয়, ‘ নিউ মার্কেটের কালীচরণের দোকান থেকে প্রতি সোমবার আপিস-ফেরতা বই কিনে বাড়ি ফেরেন বিপিন চৌধুরী। যত রাজ্যের ডিটেকটিভ বই, রহস্যের বই আর ভূতের গল্প । একসঙ্গে অন্তত খান পাঁচেক বই না কিনলে তাঁর এক সপ্তাহের খোরাক হয় না। বাড়িতে তিনি একা মানুষ। লোকের সঙ্গে মেলামেশা তাঁর ধাতে আসে না, আড্ডার বাতিক নেই, বন্ধুপরিজনের সংখ্যাও কম।”
অর্থাৎ বিপিন চৌধুরী অনেকটা আভিজাত্যসম্পন্ন লোক। যাকে ইংরেজিতে পোশ বা ফিটফাট বলা হয়। এরকম ব্যক্তিকে যখন রাঁচিতে ঘুরতে গিয়েছিলেন বলা হয় তখন প্রথমে তাঁর নিকট এটা অবিশ্বাস্য এবং কোথাও ভুল হচ্ছে এরকম ধারণা হলেও তিনি বিষয়টিকে আমলে নিতে বাধ্য হয়েছেন। এরকম ব্যক্তি চাইলেই রাঁচি কেন বিখ্যাত যেকোন স্থান হতে ঘুরে আসতে পারেন।
একইভাবে ‘নীল আতঙ্ক‘ নামকে গল্পেও আমরা একজন গল্পকথক লেখক যার নাম অনিরুদ্ধ বোস সাহেবের সন্ধান পাই যিনি অবস্থাসম্পন্ন না হলেও চাকরি করে যা কামাই করেন তাতে একা মানুষ হিসেবে ভালোই চলে যায়। এছাড়া তাঁর সর্দার শঙ্কর রোডে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে আছেন, দোতালায় দু’খানা ঘর, দক্ষিণ খোলা । দু’বছর ধরে একটি অ্যাম্বাসাডার গাড়ি কিনেছেন। এখন চাকরির পাশাপাশি সাহিত্য চর্চাও করছেন। এছাড়া তাঁর অন্যান্য যোগ্যতাও রায় সাহেব উল্লেখ করেছেন যা সাধারণত আমরা আকাঙ্খিত ব্যক্তিদের মাঝে পাই। এখানে উল্লেখ করেন যে, লেখকের বড় মামার সুপারিশেই তাঁর চাকরিটা হয় তবে সেখানে তাঁর যোগ্যতাও যে কম নয়। কেননা, ছাত্র হিসেবে তাঁর রেকর্ড ভাল, ইংরিজিটাও বেশ গড়্গড় করে বলতে পারে, আর তা ছাড়া তাঁর মাঝে আত্মনির্ভরতা এবং স্মার্টনেস আছে যা তাঁকে ইন্টারভিউয়ের সময় সহায়তা করেছিল।
অনিরুদ্ধ বোস তাঁর ঘুরাঘুরির কথা এভাবে উল্লেখ করেন,
“ মুঙ্গেরে ছেলেবেলার কথাটা বললে হয়তো আমার চরিত্রের একটা দিক বুঝতে সাহায্য করবে। কলকাতায় একনাগাড়ে বেশিদিন থাকতে আমার প্রাণ হাঁপিয়ে উঠে। এত লোকের ভিড়, ট্রামবাসের ঘরঘরানি, এত হইহল্লা, জীবনধারণের এত সমস্যা- মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে এইসবের থেকে ছুটে বেরিয়ে চলে যাই। আমার গাড়িটা কেনার পর কয়েকবার এটা করেওছি। ছুটির দিন একবার ডায়মন্ড হারবারে, একবার পোর্টক্যানিং, আর একবার দমদমের রাস্তা দিয়ে সেই একেবারে হাসনাবাদ পর্যন্ত ঘুরে এসেছি। একাই গিয়েছি প্রতিবার , কারণ এ ধরণের আউটিং – এ উৎসাহ প্রকাশ করার মতো কাউকে খুঁজে পাইনি।”
যাইহোক এ গল্পে লেখক তাঁর বন্ধু প্রমোদের থেকে দাওয়াত পেয়ে ‘দুমকা’-র উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। যদিও তাঁকে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বের হতে হয়। আগে থেকেই কিছু ছুটি পাওনা থাকার কারণে ছুটি পেতে তাঁর সমস্যা হয় নি।
অর্থাৎ সত্যজিৎ রায় অনিরুদ্ধ বোসের চরিত্রটি এমনভাবে তৈরি করেছেন যার মাঝে আমরা একইধারে স্বাধীনচেতা এবং স্বচ্ছলতা উভয়টাই পাই। তাই তিনি চাইলেই কলকাতার জীবন থেকে বের হতে পারেন। যদিও তা বেশিক্ষণের জন্য নয়। এই চাওয়াটাই বা মেট্রো জীবনের কয়জন নাগরিক পুরা করতে পারে ।
এরপর ‘বাতিকবাবু’ গল্পে আমরা একাধারে বেশ কিছু চরিত্রের উপস্থিতি দেখতে পাই। এই গল্পের গল্পকথক ব্যাঙ্কে চাকরি করেন। দিন দশেকের ছুটি জমে ছিল তাই বৈশাখের মাঝামাঝি গিয়ে দার্জিলিং শহরে গিয়ে উপস্থিত হলেন। অন্যদিকে বাতিকবাবু বছর পাঁচেক হল দার্জিলিঙে আছেন । একটি বাড়িতে ঘরভাড়া নিয়ে থাকেন। ভদ্রলোক একসময় কটকের র্যাভেনশ কলেজে ফিজিক্স পড়াতেন। জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি আছে। ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র ছিলেন। চাকরি-বাকরি ছেড়ে দার্জিলিঙে চলে এসেছেন । পৈতৃক সম্পত্তি কিছু আছে।
বাতিকবাবুর অন্যান্য দেশ ঘোরারও বেশ অভিজ্ঞতা রয়েছে। হয়তবা তিনি বিভিন্ন স্থানে তাঁর কাজের জন্যই গিয়েছেইলেন। যেমনঃ তিনি সুইজারল্যান্ডের লুসার্ন হতে একটি দস্তানা সর্বপ্রথম সংগ্রহ করেন। তারপরে তিনি একস্থানে বলেন, ‘দেশে ফিরে আমি কটকের কলেজে প্রফেসারি আরম্ভ করেছি। ছুটিতে এখানে-ওখানে বেড়াতে যেতাম। একবার ওয়ালটেয়ারে…………” অর্থাৎ আমাদের এ ব্যক্তির রয়েছে নানা অভিজ্ঞতা। দেশ বিদেশের অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতা তৈরি হওয়ার পিছনে যে ব্যক্তির স্বচ্ছলতার বিশাল এক ভূমিকা রয়েছে তা সহজেই অনুমেয়।
‘বিষফুল’ গল্পতে উল্লেখিত জগন্ময়বাবু চরিত্রও একটি অবস্থাসম্পন্ন চরিত্র। তিনি কাঠঝুমরিতে চেঞ্জে এসেছেন। জগন্ময়বাবু যে একজন সামর্থবান ব্যক্তি তা সত্যজিৎ রায় এভাবে উল্লেখ করেন,
‘ গত বছর থেকেই একটা হাঁপের কষ্ট অনুভব করতে শুরু করেছেন জগন্ময়বাবু। ডাক্তার-শুধু ডাক্তার কেন, চেনাশোনা সকলেই- বলেছেন ড্রাই ক্লাইমেটে ক’টা দিন কাটিয়ে আসার কথা। – ‘বিয়ে তো করোনি ; এত টাকা কার জন্য পুষে রাখছ ? একটু খরচ-টরচ করো। আমাদের পেছনে না করবে তো অন্তত নিজের পিছনেই করো !’ এই ‘এত টাকা’র ব্যাপারটা জগন্ময়বাবুর মোটামুটি নিস্তরঙ্গ জীবনে একটা ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ মহাসামুদ্রিক ঢেউ-এর মতো। তিনদিন রেসের মাঠে যাবার পর চতুর্থ দিনই জ্যাকপট পেয়ে যান ভদ্রলোক।’ অর্থাৎ জগন্ময়বাবু যে আর দশটি বাঙ্গালি বাবুর মত নন তা এতেই বুঝে আসার কথা। যার পক্ষে ডাক্তারের ‘চেঞ্জে যান’ এটাইপের পরামর্শ মান্য করা অতি সামান্য কোন ব্যাপার। এই গল্পেই জগন্ময়বাবুর প্রতিদ্বন্দ্বী ‘ পবিত্রবাবু’ যার দেখা একেবারে গল্পের শেষে এসে আমরা পাই তিনিও কিন্ত ভালোই টাকা পয়সাওয়ালা। যার ভালো নাম পবিত্র ভট্টাচার্য । তিনিও শুধু লিখার জন্য কাঠঝুমরিতে আসেন। তিনি একজন বড় রাইটার। অর্থাৎ তাঁর পক্ষেও এরকম একটু আধটু গল্পের প্লট পাওয়ার জন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আশ্রয়ে যাওয়া খুব কঠিন কোন বিষয় নয়।
সত্যজিৎ তাঁর ছোটগল্পে কোন অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় পাগলাটে কোন যুবার চরিত্র সেরকমভাবে না আনলেও আমরা তার ছোট এক অবস্থান দেখতে পাই ‘অতিথি’ নামক গল্পে । এই গল্পে অতিথি হিসেবে যে ‘ছোট মামার’ সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় তিনি যে একজন তুখোড় ভূপর্যটক তা তার বিদায়ের পর ‘শেতলমামা’-র কাছ থেকে আমরা জানতে পারি। শেতলমামা বলেন,
‘পুলিন রায়ের মতো অত বড় ভূপর্যটক ভারতবর্ষে আর হয়নি। আর সব নিজের রোজগারে ঘোরা। খালাসিগিরি থেকে শুরু করে কুলিগিরি, কাঠের মজুরি, খবরের কাগজ বিক্রি , দোকানদারি লরির ড্রাইভারি- কোনও কাজ সে বাদ দেয়নি। তার অভিজ্ঞতার কাছে গল্প হার মেনে যায়। সে বাঘের কবলে পড়েছে , সাপের ছোবল খেয়েছে, সাহারায় দস্যুদের হাত থেকে রেহাই পেয়ে এসেছে, জাহাজডুবি থেকে সাতরে উঠেছে ম্যাডাগাস্কারের ডাঙায়। থার্টি নাইনে সে ভারতবর্ষ ছেড়ে আফগানিস্তানের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে পড়ে । সে বলে বাপের বাড়ির মায়া একবার কাটাতে পারলে সারা পৃথিবীটাই হয়ে যায় নিজের ঘর। সাদা কালো ছোট বর জংলি সভ্য সব এক হয়ে যায়’
এ চরিত্রের কথা শুনে মনে হবে এ বোধহয় বিভূতিভূষণের ‘চাদের পাহাড়’ আর নয়তো ‘হীরা মানিক জ্বলে’-র কোন চরিত্র। অর্থাৎ যাদের থেকে আমরা আশা করি যে পৃথিবীটা জয় করাই তাদের আসল উদ্দেশ্য। যারা সংসারের মায়া ত্যাগ করে পৃথিবীর মায়াতে নিজেদেরকে জড়ায়। ভ্রমণ যাদের আকাঙ্খিত বিষয়। প্রকৃতি প্রেম যাদের আসল ভালোবাসা। সত্যজিৎ রায়ের এই পুলিনবাবু সেরকম এক চরিত্রই বটে।
‘ফার্স্ট ক্লাস কামরা‘-র রঞ্জন সাহেব কে আমরা ইংরেজ সাহেব প্রেমিক একজন কেতাদূরস্ত সাহেব হিসেবে পাই। যিনি ইংরেজদের নিয়ে কোন নেগেটিভ কথাও শুনতেও পছন্দ করেন না। রঞ্জন কুণ্ডু এবং পুলকেশ সরকার দুজনই ঈদ এবং পুজোর দশদিনের ছুটিতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। রঞ্জন কুণ্ডু একটা সাহেবি নামওয়ালা সওদাগরি অফিসের উচ্চপদস্থ কর্মচারী। আর পুলকেশ সরকার একটি বড় বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার। রায়পুরে দুজনের কমন ফ্রেন্ড মোহিত বোসের সঙ্গে এক সপ্তাহ কাটিয়ে গাড়িতে করে বস্তারের অরণ্য অঞ্চল ঘুরে দেখে কাটানোর প্ল্যান তাদের।
আমরা যদি আবারো ‘ভক্ত‘ গল্পের দিকে তাকাই তাহলে দেখব এখানে দুটো চরিত্র দেখানো হয় একজন হলেন অরূপরতন সরকার অন্যজন হলেন অমলেশ মৌলিক। অরূপবাবু একটি ইনসিওরেন্স কোম্পানিতে চাকরি করেন। এবং তার চাকরি জীবনে অনেক কষ্ট রয়েছে। আবার অমলেশ মৌলিক একজন জনপ্রিয় শিশু সাহিত্যিক। যার ভক্ত অনুরাগীর সংখ্যা অনেক। তবে সত্যজিৎ রায় উভয়ের মধ্যে একটি সাধারণ সম্পর্ক গড়েছেন যে তারা উভয়েই মূলত নিরিবিলি এবং নির্ঝঞ্ঝাট এক ছুটি কাটানোর জন্য পুরীতে এসেছেন। তবে দুজনের মধ্যে স্পষ্ট এক পার্থক্য খুব কৌশলে সত্যজিৎ রায় আমাদেরকে দেখিয়েছেন। গল্পের একেবারে শুরুতে অরুপবাবু যে হোটেলে উঠেছেন তার বর্ণনা এভাবে দেওয়া হয় ‘ তিনি যেখানে এসে উঠেছেন, সেই সাগরিকা হোটেল থেকে সমুদ্র দেখা না গেলেও , রাত্তিরে বাসিন্দাদের কলরব বন্ধ হয়ে গেলে দিব্যি ঢেউয়ের শব্দ শোনা যায়।’ কিন্ত অপরদিকে আমরা যদি অমলেশ মৌলিক যে হোটেলে উঠেছে সেই হোটেলের নামই ‘সি-ভিউ’ । অর্থাৎ এই হোটেল থেকে সমুদ্র দেখা যায়। সমুদ্র দেখার জন্য যারা কখনো কোন হোটেলে থেকেছেন তারা জানেন যে যে হোটেল বা হোটেলের রুম থেকে সমুদ্র দেখা যায় সেই হোটেল্বা রুমের খরচ একটু বেশিই হয়। অরূপরতন এবং অমলেশ মৌলিকের মধ্যকার এই সূক্ষ পার্থক্যটি রায় সাহেব অত্যন্ত সূক্ষভাবে তুলে ধরেছেন।
‘স্পটলাইট‘ গল্পে আমরা দেখতে পাই গল্পকথক তাঁর পরিবার সমেত ছোটনাগপুরের কোন ছোট্ট শহরে পুজোর ছুটি কাটাতে এসেছেন। আর এখানে তাদের এই ছুটি কাটাতে আসা এই প্রথম নয়। তারা এর আগেও বহুবার এখানে এসেছেন। এখানে তারা এসেছেন দশদিনের ছুটি কাটাতে। গল্পকথকের ভাষায় ‘ দলে ভারী হয়ে আসি, তাই গাড়ি-ঘোড়া সিনেমা-থিয়েটার দোকান-পাট না থাকলেও দশটা দিন দারুন ফুর্তিতে কেটে যায়। একটা বছরের ছুটির সঙ্গে আরেকটা বছরের ছুটির তফাত কী জিজ্ঞেস করলে মুশকিলে পড়তে হবে , কারণ চারবেলা খাওয়া এক – সেই মুরগি মাংস ডিম অড়হর ডাল , বাড়িতে দোওয়া গোরুর দুধ, বাড়ির গাছের জামরুল পেয়ারা; দিনের রুটিন এক- রাত দশটায় ঘুম ভোর ছ’টায় ওঠা, দুপুরে তাস মোনপলি , বিকেলে চায়ের পর রাজা পাহাড় অবধি ইভনিং ওয়ক ; অন্তত একদিন কালীঝোরার দিন পিকনিক ; দিনে ঝলমলে রোদ আর তুলো পেঁজা মেঘ ; রাত্তিরের আকাশের এ-মাথা থেকে ও-মাথা ছড়ানো ছায়াপথ , কাক শালিক কাঠবেড়াল গুবরে ভোমরা গিরগিটি কাচপোকা কুঁচফল সব এক ।”
গল্পকথক কি করেন তা বুঝে উঠা না গেলেও সে যে তার ছাত্রত্ত্বের গন্ডি এখনো পার করেনি তা সহজেই আঁচ করা যায়। কিন্ত কথকের খুড়তুতো ভাই ছেনিদা একজন সাংবাদিক আর তার ছোটদা একজন ছাত্র বা সদ্য পড়ালেখা শেষ করা কোন যুবক আর তার ছোটমামা হাত দেখেন। খুড়তুতো ভাই ছেনিদা তার অফিস থেকে একেবারে ছুটি পায়না বললেই চলে। অর্থাৎ এই পরিবারটির দিকে যদি আমরা সামগ্রিকভাবে দেখি তাহলে একে মধ্যবিত্ত পরিবারের থেকে বড় কিছু মনে হয় না। কিন্ত তারা তাদের শখের বসের প্রতি বছর আবহাওয়া পরিবর্তনের জাকজমকের রীতিটি ধরে রেখেছেন। যা বুঝা যায় তা হল গল্পকথকের পিতাই মূলত এখানে আসার ব্যাপারে মূল উদ্যোক্তা। কেননা গল্পের শুরুতে তিনি বলেন, “ আজকাল আর খাবার-দাবার আগের মতো সস্তা নেই ঠিকই , কিন্তু জলবায়ুটা তো ফ্রি, আরে সেটার কোয়ালিটি যে পড়ে গেছে সে-কথা তো কেউ বলতে পারবে না।” এতে বুঝা যায় যে এই পরিবার যতটুকুই ইনকাম করুক না কেন তাদের বছরান্তে ছুটিতে দূরে কোথাও বেড়ানোটা অনেকটা রুটিনমাফিক। এর আগে তারা আন্দামানেও ঘুরতে গিয়েছিল। এই বছরান্তে হয়তবা তাদের পুরো বছরের একঘেয়েমিতা কাটানোর টনিক হিসেবে কাজ দেয়। একই গল্পে ‘অংশুমান চ্যাটার্জি নামক এক অভিনেতার প্রসঙ্গ নিয়ে আসা হয়। তিনিও ছুটি কাটাতে এসেছেন ছোটনাগপুরে। কিন্ত তিনি অন্যান্যদের মত নিরিবিলি ছুটি কাটাতে এসেছেন এ কথা বলা মুশকিল। কেননা সে যেখানেই যায় সেখানেই অসংখ্য লোক তাঁকে ঘিরে রাখে। কিন্ত শহরে যে আগ থেকেই একজন প্রতিদ্বন্দ্বী এসে হাজির। তাই হয়তবা অংশুমান চ্যাটার্জি তার চেলাচামুণ্ডাদের নিয়ে দশদিনের ছুটি পাঁচদিনে খতম করে কলকাতায় ফিরে যায়। তবে সে কেন ফিরে যায় সত্যজিৎ এই বিষয়টি স্পষ্ট করেন নি। হয়তবা তার নতুন কোন কাজের ডাক পড়েছে তাই ছুটি শেষ করা সম্ভব হয় নি। অথবা তাঁকে ঘিরে মানুষ জমে থাকুক এটাই তার পছন্দ। সেই মানুষ যদি অন্যকারো দিকে ফিরে যায় তাহলে তা যে কিছুটা হলেও খ্যাত নায়ক কে খানিকটা অখ্যাত করে ফেলে তা সহ্য করা কদিনের জন্যই বা সম্ভব হয়। তাই তিনি ফিরে গিয়ে থাকতে পারেন। তবে যাই হোক সত্যজিৎ রায় যে পরিবারটিকে এই গল্পতে তুলে ধরেছেন এরকম পরিবার বাঙ্গালি সমাজে এখনো বিরল।
এছাড়া আমরা‘ক্লাস্ফ্রেন্ড ‘ গল্পে এক উচ্চবিত্ত মানুষের সন্ধান পাই যিনি সন্ত্রীক উইকেন্ডে স্ত্রী সহ ঘুরতে বেড়ান। কিন্ত তার ছোটবেলার স্কুলের এক ফ্রেন্ড তার নিকট সাহয্যের জন্য আসলে তিনি তাকে পূনরায় সেই দিনটাতেই আসতে বলেন যে দিনটাতে তিনি বেড়াতে যাবেন। একেবারে প্ল্যান করে মানুষকে এমন সময়ে আসতে বলা যে সময়ে তিনি আসলে থাকবেন না। অর্থাৎ অনেক সময় উচ্চবিত্তদের নিকট তাদের বেড়াতে যাওয়াটা মানুষ , দায়িত্ব থেকে নিজেকে লুকানোর চেষ্টাও হতে পারে। তিনি বারুইপুরে গিয়ে মাছ, পোল্ট্রির মুরগির ডিম, আর গাছের আম জাম ডাব পেয়ারা খেয়ে , বকুল গাছের ছায়ায় সতরঞ্চি পেতে বুকে বালিশ নিয়ে তাস খেলে শরীর ও মনের অবসাদ দূর করে। অথচ তিনি যখন তার প্রকৃতির মাঝে তার অবসাদ দূর করছিলেন ঠিক তখনই তার এক অসহায় বন্ধু তার বাড়ি থেকে ফিরে যায় ! প্রকৃতির মাঝে ঘুরতে যাওয়াটা অবশ্যই অন্যায় নয় । কিন্ত এ জিনিস কে নিজের দায়িত্ব থেকে সড়িয়ে ফেলাবার বা অসহায় মানুষদের থেকে নিজেকে লুকানোর কারণ বানানো অবশ্যয়ই ভাল কিছু নয়।
মূল কথা হল সত্যজিৎ পুরো বাঙ্গালি সমাজটাকেই দেখতে চেয়েছেন প্রকৃতিপ্রেমী হিসেবে। কিন্ত এক শ্রেণীর প্রকৃতিপ্রেম কে তিনি খুব সাধারণ গোছের দেখিয়েছেন। যে সাধারণের মধ্যে রয়েছে অমৃত কিছু। যে সাধারণ অনেক কষ্টের পাথর কে সড়িয়ে দিতে সক্ষম। যে সাধারণের উপর ভর করে আরো কয়েকটা বছর বেচে থাকা যায়। যে সাধারণ একাকীত্বকে ভুলিয়ে দিয়ে আবিষ্ট করে নতুন কোন সম্পর্কের সাথে। তবে অন্যদিকে তিনি অন্য একটি শ্রেণীর প্রকৃতি প্রেম কে তুলে ধরেছেন একটু ভিন্নভাবে। তবে তাদের প্রকৃতিপ্রেম পরিণত হয় রহস্য , অস্থিরতা আর নতুন কোন ভাবনাতে। জানি না, সত্যজিৎ কেন এ কাজটা করেছেন।
প্রকৃতি যখন প্রকৃতি অভিযানে পরিণত হয়ঃ
সত্যজিৎ রায়ের গল্পসমূহে প্রকৃতি নিয়ে আরেকটি উল্লেখযোগ্য উপাদান পাওয়া যায় আর তাহল প্রকৃতি অভিযান। অর্থাৎ প্রকৃতি নিয়ে কৌতুহলী হয়ে উঠা। প্রকৃতির রহস্য কে জানার চেষ্টা করা। প্রকৃতি দুয়ারে নতুন করে প্রবেশ করা। এই বিষয়টি তিনি তার লেখা বেশকিছু ছোট গল্পে নিয়ে এসেছেন। আমরা এবার এই বিষয়টি এক এক করে দেখব।
আবারো চলুন ‘সেপ্টোপাসের খিদে‘ গল্পের পটভূমি নিয়ে আলোচনা করি। গল্পে আমরা কান্তিবাবু নামক একজন জিজ্ঞাসু ব্যক্তির সাথে পরিচিত হই। যিনি এককালে বটানি নিয়ে প্রোফেসারি করলেও পরবর্তীতে প্রোফেসারি ছেড়ে দুষ্প্রাপ্য গাছের সন্ধানে বের হয়ে যান। সংগ্রহ করেছেন অসংখ্য অর্কিড এবং কার্নিভোরাস প্লান্টস। অসংখ্য বন বাদাড়ে ঘুরেছেন। গিয়েছেন নানা জায়গাতে। সংগ্রহের তালিকা দিনকে দিন বড় করছেন। তার সংগ্রহের তালিকাতে আছে নেপেনথিস বা পিচার প্ল্যান্ট। তাঁর মাংসাশী উদ্ভিদের কিছু সংগ্রহ করছেন নেপাল হতে, কিছু করেছেন আফ্রিকা হতে আর কিছু করেছেন মধ্য আমেরিকা হতে। এরকম নানা জায়গাত হতে উদ্ভিদ সংগ্রহ করতে করতেই এক সময় সংগ্রহ করে ফেলেন ‘ সেপ্টোপাস’ নামক দানবীয় এক গাছ। এটা তিনি সংগ্রহ করেন মধ্য আমেরিকার নিকারাগুয়া হ্রদের কাছে এক গভীর জঙ্গল থেকে। এই গাছ তিনি কিভাবে সংগ্রহ করেছেন তা জানতে চাইলে সেই স্মৃতি তিনি এভাবে বর্ণনা করেন, “ ওই অঞ্চলেই যে আছে সেটা জানা ছিল। তোমরা বোধহয় প্রোফেসর ডানস্টন -এর কথা শোনোনি ? উদ্ভিদবিজ্ঞানী ও পর্যটক ছিলেন। মধ্য আমেরিকায় গাছপালার সন্ধান করতে গিয়ে প্রাণ হারান থিক কীভাবে তাঁর মৃত্যু হয় কেউ জানতে পারেনি; মৃতদেহ সম্পূর্ণ নিখোঁজ হয়ে যায়। তাঁর তৎকালীন ডায়রির শেষের দিকে এ গাছটার উল্লেখ পাওয়া যায়।
‘ আমি তাই প্রথম সুযোগেই নিকারাগুয়ার দিকে চলে যাই। গুয়াটেমালা থেকেই স্থানীয় লোকের কাছে এ গাছের বর্ণনা শুনতে থাকি। তারা বলে শয়তান গাছ। শেষটায় অবিশ্যি এমন গাছ একাধিক চোখে পড়ে। বাঁদর , আরমাডিলো , অনেক কিছু খেতে দেখেছি এ গাছকে। অনেক খোঁজার পর একটা অল্পবয়স্ক ছোটখাটো চারাগাছ পেয়ে সেটাকে তুলে আনি। দু’বছরে গাছের কী সাইজ হয়েছে দেখতেই পাচ্ছ।’ এই হল বর্ণনা। যদিও আমরা জানি রায় সাহেব এখানে যে গাছের কথা উল্লেখ করেছেন তা একটি কাল্পনিক উদ্ভিদ। কিন্ত তিনি ঘটনা সাজাতে এ গাছের গুরত্ব কান্তিবাবুর ভাষাতে এভাবে তুলে ধরেন। কান্তিবাবু বলেন ‘ এর অধিকাংশ গাছের কথাই তোমার বটানির বইয়ে পাবে। তবে আমার সবচেয়ে আশ্চর্য সংগ্রহ , সেটির কথা আমি না লিখলে কোনও বইয়ে থাকবে না।’
বিজ্ঞানীদের বড় বড় আবিষ্কারের পিছনে কিন্ত এই অভিযান বিষয়টুকু কাজ করে। প্রকৃতির অভিযান মানুষ করে মূলত অজানা কে জানার জন্য। মানুষ যদি অভিযানে না বের হত তাহলে সে নিজেও জানত না যে আসলে তার অজানার পরিধি কত বড়। সত্যজিৎ রায় এই গল্পে ‘কান্তিবাবু’-কে দিয়ে মূলত সেরকম অনুসন্ধিৎসুদের কে সামনে নিয়ে এসেছেন । যাদের পাগলাটে অভিযানের জন্যই হয়তবা আমরা আজ এত আধুনিক।
‘সদানন্দের খুদে জগৎ‘ গল্পে আমরা সদানন্দের অভিযাত্রিক অভিপ্রায় দেখতে পাই। সদানন্দের খুব আগ্রহ প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানের ব্যাপারে। সে প্রকৃতির বিভিন্ন জিনিস দেখে নিজে নিজেই হেসে উঠে। এরকমই একদিন তার আগ্রহ হল পিপড়েদের সম্পর্কে জানার। সেই পিপড়েদের কে সে জানার জন্য এতটাই আগ্রহী হয়ে উঠল যে ক্লাসে এসেও তার মন টিকত না। তার মন থাকত তার বাসার জানালার ধারের পিঁপড়ের কাছে। একদিন ক্লাসেই সে পিঁপড়ের দল আবিষ্কার করল। সদানন্দ কে এখন আর পায় কে ! টিফিনের ঘন্টা পড়তেই সে চলে গেল ক্লাসের পিছনের দিকটায়। গিয়ে সে ফাটল খুঁজে বের করে যে ফাটল দিয়ে এক এক করে পিঁপড়েরা আসছিল। সদানন্দের ভাষাতেই তাহলে চলুন পড়ে নেই তার অভিযানের কথা। ‘ দেখলাম পিঁপড়েগুলো ফাটল দিয়ে বেরিয়ে ঘাসের ফাঁক দিয়ে সোজা চলেছে পেয়ারা গাছটার দিকে।
পিঁপড়ের লাইন ধরে গিয়ে পেয়ারা গাছের গুঁড়ির কাছেই যে জিনিসটা বেরোলো, সেটাকে দুর্গ ছাড়া আর কি বলব ?
স্পষ্ট দেখলাম একটা দুর্গের মতো উঁচু মাটির ঢিবি, তার তলার দিকে গেট , আর সেই গেট দিয়ে সারি বেঁধে ভিতরে ঢুকছে পিঁপড়ের সৈন্যদল। আমার ভীষণ ইচ্ছে হল দুর্গের ভিতরটা একটু দেখি। পকেটে আমার পেনসিলটা ছিল , তার ডগাটা দিয়ে ঢিবির উপরের মাটিটা আস্তে আস্তে একটু একটু করে সরাতে লাগলাম। প্রথমে কিছুই বেরোল না, কিন্ত তারপর যা দেখলাম তাতে আমি সত্যিই অবাক ! দুর্গের ভিতর অসংখ্য ছোট ছোট খুপরি আর সেই খুপরির একটা থেকে আরেকটায় যাবার জন্য অসংখ্য কিলবিলে সুড়ঙ্গ ! কী আশ্চর্য , কি অদ্ভুত ! এই খুদে হাত-পা দিয়ে এরকম ঘর বানাল কী করে এরা ? এত বুদ্ধি হল কী করে এদের ? এদেরও কি ইস্কুল আছে , মাস্টার আছে ? এরাওকি লেখাপড়া শেখে , অঙ্ক কষে , ছবি আঁকে , কারিগরি শেখে ?”
এক পিঁপড়ে থেকে সদানন্দের মনে কত প্রশ্ন ! রায় সাহেব প্রকৃতিকে এক অভিযানে টেনে নিয়েছেন। মানুষের আগ্রহ বাড়িয়েছেন। প্রকৃতির উপাদানের অভাব নেই। তাই আগ্রহ শেষ হয়ে যাওয়ারও সুযোগ কম এখানে। মানুষের আগ্রহ যদি প্রকৃতি কেন্দ্রিক হত তাহলে হয়তবা মানুষকে এত সহজে হতাশাতে পড়তে হত না।
‘রতনবাবু আর সেই লোকটা ‘ গল্পের প্রধান চরিত্র রতনবাবুর কিছু দিক আমরা পূর্বেই তুলে ধরেছি। রতনবাবু প্রকৃতির খুব সাধারণ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হলেও তার ভিতরে আমরা এক অজানাকে জানার আকাঙ্খা দেখতে পাই। এই অজানাকে জানতে গিয়েই রতনবাবু তার চরিত্রের হুবুহু এক লোক কে আবিষ্কার করে ফেলেন। রায় সাহেব বিষয়টি এভাবে উল্লেখ করেন, ‘ প্রতিদিন বিকেলবেলাটা এই ডোবার ধারে বসেই হয়তো রতনবাবু বাকি ছুটিটা কাটিয়ে দিতে পারতেন, কিন্ত দ্বিতীয় দিন আরও কিছু আবিষ্কারের আশায় রতনবাবু অন্য আরেকটা পথ দিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন।
মাইলখানেক যাবার পর পথে একপাল ছাগল পড়ার দরুন তাঁর হাঁটা কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ রাখতে হল। রাস্তা খালি হবার পর আরও মিনিটপাঁচেক হাঁটতেই দেখলেন সামনে একটা কাঠের পুল দেখা যাচ্ছে। আরও এগিয়ে গিয়ে বুঝলেন সেটা একটা ওভারব্রিজ। তার নীচ দিয়ে চলে গেছে রেলের লাইন। পূবদিকে দূরে স্টেশনটা দেখা যাচ্ছে , আর পশ্চিমদিকে যতদূর চোখ যায় সোজা চলে গেছে সমান্তরাল দুটো লোহার পাত। এখন যদি হঠাৎ একটা ট্রেন এসে পড়ে, আর ব্রিজের তলা দিয়ে সেটা যদি যায় তা হলে অদ্ভুত ব্যাপার হবে, সেটা ভাবতেই রতনবাবুর গাঁয়ে কাঁটা দিল।
একদৃষ্টে রেললাইনের দিকে দেখছিলেন বলেই বোধহয় কখন যে আরেকটি লোক এসে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছে সেটা রতনবাবু খেয়াল করেননি, তাই পাশে তাকাতেই তাঁকে চমকে উঠতে হল ।’
কত সাধারণ জিনিস দেখার জন্য রতনবাবু বের হয়েছেন ভাবতেও অবাক লাগে। অভিযান যে সবসময় অভিযান নাম দিয়ে করতে হবে ব্যাপারটা এরকম নয়। দেখুন ব্যাপারটা, রতনবাবু চাইলে ডোবাতে বসেই তাঁর বাকি ছুটিটা কাটিয়ে দিতে পারতেন। কিন্ত তিনি তা করেন নি। নতুন কিছু দেখা বা জানার জন্য সে অন্য পথ ধরলেন। সেখানেও যে আহামরি কোন কিছু ছিল ব্যাপারটা এরকম নয়। কিন্ত রতনবাবু এমন কিছু আবিষ্কার করলেন যা থেকে নিজ কল্পনাতে ডুব দিয়ে শিহরিত হলেন। প্রকৃতির মাঝে অভিযান আপনাকে এরকম শিহরিত হওয়ার সুযোগ করে দিবে। যা আপনার নিত্য দিনের ব্যস্ততার জীবনে পাবেন না। ওখানে আছে শুধু বসের ধমকানি আর খাটুনি। এখানে শিহরিত হওয়ার সুযোগটাই বা কোথায় ।
এরপর ‘ প্রোফেসর হিজিবিজবিজ‘ গল্প নিয়ে আলোচনা করা যাক। এই গল্পের কথক যিনি মূলত একজন লেখক কিন্ত অফিসের কাজের চাপে যিনি বেড়াবার সুযোগ করতে পারেন না। এই প্রসঙ্গটি আমরা প্রথমেই তুলে ধরেছি। কিন্ত তাঁর মাঝেও যে একটা অভিযানসুলভ স্পৃহা রয়েছে তা আমরা এখানে আলোচনা করব। কথক বলেন যে, প্রথম দু’দিন সমুদ্রের তীর ধরে পশ্চিম দিকটায় গেছি; তৃতীয় দিন মনে হল একবার পূব দিকটাতেও যাওয়া দরকার; বালির ওপর আদ্যিকালের নোনাধরা পোড়া বাড়িগুলো ভারী অদ্ভুত লাগে। মিস্টার অ্যারাটুন বলছিলেন এগুলো নাকি প্রায় তিন-চারশো বছরের পুরনো। এককালে গোপালপুর নাকি ওলন্দাজদের একটা ঘাঁটি ছিল। এসব বাড়ির বেশিরভাগই নাকি সেই সময়কার। দেয়ালের ইটগুলো চ্যাপটা আর ছোট ছোট, দরজা জানলার বাকি রয়েছে শুধু ফাঁকগুলো । , আর ছাত বলতেও ছাউনির চেয়ে ফাঁকটাই বেশি। একটা বাড়ির ভিতর ঢুকে দেখেছি , ভারী থমথমে মনে হয়।’
গল্পকথকের এরকম এলোমেলো ঘুরতে ঘুরতে এক সময় দুজন প্রৌঢ় বাঙালি ভদ্রলোকের সাথে তাঁর দেখা হয়। তাদের সাথে কিছুক্ষণ আলাপ হওয়ার পর যখন তিনি এগোতে যাবেন , তখন পরিচয় হওয়া ভদ্রলোক প্রশ্ন করে বসেন,
‘ওদিকটায় যাচ্ছেন কোথায় ?’
কথক বলেন , ‘এমনি- একটু বেড়াব আর কি ।’
‘কেন বলুন তো ?’
আচ্ছা মুশকিল তো ! বেড়াতে যাচ্ছি কেন সেটাও বলতে হবে ?’
ভদ্রলোক বললেন, ‘ বছরখানেক আগে হলে কিছু বলার ছিল না। যেখানে মন চায় নির্ভয়ে ঘুরে আসতে পারতেন। গত সেপ্টেম্বরে পুবদিকে নুলিয়া বস্তি ছাড়িয়ে মাইলখানেক দূরে একটি প্রাণী এসে আস্তানা গেড়েছেন। ওই পোড়োবাড়িগুলো দেখছেন , ওরই মতন একটি বাড়িতে। আমি অবিশ্যি নিজে দেখিনি সে বাড়ি। এখানকার পোস্টমাস্টার মহাপাত্র বলছিল দেখেছে।”
গল্পকথকের অভিযানসুলভ স্পৃহা প্রমাণের জন্য আমরা গল্পের এই অংশ পর্যন্তই থামতে পারি। মানুষ আসলে বেড়াতে যায় স্বাধীন হওয়ার জন্য। তাঁর ব্যক্তিগত আকাঙ্খা অনেকটা এরকম থাকে যে যতদূর চোখ যায় ততদূর আমি যাব। আমি থামতে চাই না। অচেনা জায়গাতে এসেছি জানার জন্য অদেখা জিনিসকে দেখার জন্য। সেখানে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে বসে ওদিকে কেন যাচ্ছেন ? বা ওদিকে যাবেন না । অথবা ওদিকে গেলে সমস্যা হতে পারে। এটাইপের কথা অনেক বিরক্তির সৃষ্টি করে। ঐ পাহাড়ে উঠবেন না। ওদিকটাতে যাবেন না। ওদিকটাতে ডাকাত আছে। ওদিকে সন্ধ্যার পরে থাকবেন না। তাহলে বিপদ হতে পারে। এরকম কথা মানুষ আসলে বেড়াতে গিয়ে বা ঘুরতে গিয়ে শুনতে চায় না। কেননা সে সব ‘না’ কে ত্যাগ করেই ছুটে এসেছে। এখানে এসেও যদি সেই সাবধানবানী শুনতে হয় তাহলে তা যে অভিযানে ভাটা ফেলে তা বলতে হয় না। কিন্ত মানুষ কে তার নিরাপত্তার জন্যই এগুলো অনেক সময় শুনতে হয়। কেননা অপরিচিত জায়গা যেমন আমার নিকট অচেনা এর বিপদও আমার অচেনা। এজন্য এরকম সতর্কবার্তা কে সমীহ করতে হয়। রায় সাহেবের এই বিশেষ গল্পকথক সেই সাবধানবানী সমীহ করেছিলেন কিনা তা না হয় গল্প পরেই জেনে নিলেন।
একই ধরনের বারণ আমরা ‘বিষফুল‘ গল্পের শুরুতেই দেখতে পাই। রায় সাহেব গল্পটি শুরুই করেছেন এক সতর্কতা দিয়ে । ‘ওদিকে যাবেন না বাবু !’ এই হল সেই বাক্য। যা জগন্ময়বাবুর বেড়াতে আসার স্বাভাবিক দিনগুলোকে অস্বাভাবিক করে তোলে। এর আগে বলেছিলাম স্থানীয় জনগণের সাবধানবানী সমীহ করা উচিত কিন্ত স্থানীয় লোকজন যে সবসময় সাধু হয়ে থাকবে ব্যাপারটা এরকমও নয়। অনেক সময় দেখা যায় তারা নিজ থেকেই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। যা প্রকৃতি প্রেমিকের স্বাভাবিক অভিযান কে ক্ষতিগ্রস্ত তো করেই এমনকি বেড়াতে আসার মজাটাও নষ্ট করে দেয়। জগন্ময়বাবু ডালটনগঞ্জে যে হাওয়া বদলের জন্য এসেছেন সেই আসা তাঁর কাজে দিয়েছে। তাঁর যে শারীরিক সমস্যার কারণে এখানে আসা সেই সমস্যা যেন শুরুতেই মিটে গেল। তাঁর এখানে আসা অবধি একদিনও নিশ্বাসের কষ্ট হয়নি। মানে বুঝাই যাচ্ছে সে খুব ফুরফুরা অবস্থায় আছে । কিন্ত কোনখান থেকে এক বালকের উদয় ঘটল আর সেই বালকের সাবধানবানী যেন তাঁর পুরো বেড়ানোর মজাটা ক্ষণে ক্ষণে লুফে নিতে থাকল। বালকটি জগন্ময়বাবুকে যে ‘বিষফুলের’ ভয় দেখিয়েছি জগন্ময়বাবু পরে সেই বিষফুল কে নিয়েই অনুসন্ধানে নেমে পড়েন। অর্থাৎ বালকটির দেয়া তথ্যমতে যে এই নির্দিষ্ট ফুলটি যদি আসলেই বিষফুল হয় তাহলে তা নিঃসন্দেহে আশ্চর্য করার মত বিষয়। জগন্ময়বাবু এ সম্পর্কে জানার জন্য , পবিত্রবাবু নামক এক ভদ্রলোককে এভাবে জিজ্ঞেস করেন, “ আপনি বিষফুলের নাম শুনেছেন ?”
পবিত্রবাবু কাগজটা ভাঁজ করে জগন্ময়বাবুর দিকে চোখ তুললেন। ‘ হলদে কমলা বেগনি ? তালহার যাবার পথে ডানদিকে রয়েছে তো ? একটা ঢিবির ওপরে ?
‘ আপনি তো সব জানেন দেখছি !’
‘বললুম তো – চারবার ঘুরে গেছি এখানে। বছর দুই থেকে দেখছি ওটা। প্রথম যেদিন দেখি সেদিন ঢিবির পাশে একটা আস্ত শুয়োরছানা মরে পড়েছিল ।’
‘বলেন কি ! তা এই নিয়ে আপনি কাউক্কে বলেননি কিছু ? আপনি তো কলকাতার লোক-কাগজে-টাগজে -?
পবিত্রবাবু উড়িয়ে দিলেন। ‘বলবার কি আছে মশাই? প্রকৃতির খামখেয়াল কত রকম হয় সব নিয়ে কি আর কাগজে লেখে ? আরও কত হাজার রকম বিষফুল বিষফল বিষপোকা বিষপাখি রয়েছে পৃথিবীতে কে জানে । আরে মশাই, কলকাতাতে বাস, সেখানে হাওয়াটাই বিষাক্ত। প্রতি নিশ্বাসে পাঁচ সেকেন্ড করে আয়ু কমে যাচ্ছে। – সেদিন দেখলুম কোথায় জানি লিখেছে। সেখানে ফুলের বিষ নিয়ে কে মাথা ঘামাতে যাচ্ছে মশাই ?
এ হল জগন্ময়াবাবুর কথিত এক বিষফুল নিয়ে অভিযান। কিন্ত এই অভিযানে তিনি শেষ পর্যন্ত নিজেকে হারাতে বসছিলেন এবং তা এই গল্পের পাঠক মাত্রেরই জানা। তবে এর পিছনে ‘বিষফুলের’ যতটা না দায় তার থেকে হাজারগুন বেশি দায় সেই গ্রাম্য বালকের। যে বালক জগন্ময়বাবুর শিরাতে শিরাতে এই ফুল নিয়ে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিল। এরকম কিন্ত বেড়াতে গেলে হয়। এরকম হয় যে কোন একস্থানে গেলাম কোন বিপদ নেই। কিন্ত হঠাৎ করে কোনখান থেকে যেন কোন বালকের উদয় হয় আর সে এসে কোন সাবধানবানী শুনিয়ে যাবে। এরপরে আপনি সাবধান বানী কে যতই উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন আর তা তত যেন আপনাকে ধীরে ধীরে চেপে ধরতে থাকবে। আপনার অভিযানসুলভ আনন্দের বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে।
‘প্রকৃতি অভিযান’ এমন একটা বিষয় যা সবথেকে রসকষবিহীন ব্যক্তিকেও তার অভি্যানের মায়াতে ফেলতে সক্ষম। তবে তা অলক্ষে। অর্থাৎ সে ব্যক্তি নিজেও জানবে না বা বুঝতে পারবে না আসলে সে প্রকৃতির মায়াতে পড়েছেন। ‘বৃহচঞ্চু‘ গল্পে সত্যজিৎ এরকম এক নিরস ব্যক্তিকে তুলে ধরেছেন। যে দুনিয়ার কোন জিনিসেই আশ্চর্য হন না। এমনকি প্রকৃতি নিয়েও তাঁর বিশেষ কোন আগ্রহ নেই। এরা যেন মানুষ হয়েও পাথর। অফিসের পশ্চিম পাশের জানালা দিয়ে জগন্ময়বাবু যখন ডবল রেনবো দেখে আশ্চর্য হয়ে তুলসীবাবু কে ডাক দিয়ে দেখাল। তখন তুলসীবাবু যেরকম অনুভূতিহীন এক জবাব দিল তা যেকোন প্রকৃতি প্রেমীকে আঘাত করবে।
তাদের মধ্যে এ নিয়ে যে বাক্যলাপ হয় তা রায় সাহেব এভাবে তুলে ধরেছেন,
আকাশে চোখ পড়াতে ভদ্রলোক ‘বাঃ’ বলে তুলসীবাবুকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘ দেখে যান মশাই, এ জিনিস ডেইলি দেখবেন না।’
তুলসীবাবু উঠে গিয়ে আকাশপানে চেয়ে বললেন, ‘ কীসের কথা বলছেন ।’
‘কেন , ডবল রেনবো !’ অবাক হয়ে বললেন জগন্ময়বাবু । ‘ আপনি কি কালার ব্লাইন্ড নাকি মশাই ?’
তুলসীবাবু জায়গায় ফিরে এলেন। – ‘ এ জিনিসও কাজ ফেলে উঠে ইয়ে দেখতে হবে ? একটার জায়গায় দুটো কেন, পঁচিশটা রামধনু উঠলেও তাতে আশ্চর্যের কী আছে জানি না মশাই । লোয়ার সারকুলার রোডে জোড়া গির্জা আছে তো; তা হলে তো তাঁর সামনে গিয়ে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।’
অর্থাৎ প্রকৃতির এরকম সৌন্দর্যের আতিথেয়তাও তুলসীবাবু কে আশ্চর্য করে না। নিরস ব্যক্তি নিরসই থাকেন। এমনকি এক জঙ্গলে গিয়ে তিনি অতিকায় এক ডিমের সন্ধান পান সেই ডিম পেয়েও তিনি আশ্চর্য হন নি। প্রকৃতি যেন তাঁর নিকট সব সৌন্দর্য নিয়ে এসে হতাশার চাদরে জড়িয়ে যায়। অবশেষে সেই ডিম ফুটে যখন বাচ্চা বের হয় তখন তুলসীবাবু আশ্চর্য না হলেও তুলসীবাবুর সাথি প্রদ্যোতবাবু ঠিকই আশ্চর্য হন।
প্রদ্যোতবাবু আশ্চর্য হয়ে মন্তব্য করে বসেন, “ আশ্চর্য ! ছানা আছে অথচ মা নেই, বাপ নেই। অন্তত কাছাকাছির মধ্যে দেখছি না।”
প্রদ্যোতবাবুর এই আশ্চর্য নিরস তুলসীবাবুর নিকট ভাল ঠেকেনি তা তুলসীবাবুর কথাতেই ফুটে উঠে। ‘ ঢের আশ্চর্য হয়েছেন ,’ ঝোলা কাঁধে নিয়ে বলুলেন তুলসীবাবু। – ‘ তিনটে বাজে , এর পর ঝপ করে সন্ধে হয়ে যাবে ।’
কিন্ত প্রকৃতি বলে কথা তুলসীবাবু পাখি দেখে আশ্চর্য হোক বা না হোক। বাচ্চা পাখিটা কিন্ত তুলসীবাবুকেই তার আপন হিসেবে গ্রহণ করে নিল। ‘ গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এসে ছানাটা তুলসীবাবুর সামনেই থামল। তারপর গলা বাড়িয়ে তার বেমানান রকম বড় ঠোঁট দিয়ে তুলসীবাবুর ধুতির কোঁচার একটা অংশে কামড়ে দিয়ে সে ভাবেই দাঁড়িয়ে রইল।’
তুলসীবাবু কিন্ত এখনো আশ্চর্য হন নি। তুলসীবাবু আশ্চর্য না হলে কি হবে এ যে ইতোমধ্যে মায়ার বন্ধন সৃষ্টি করে ফেলেছে তা তুলসীবাবুরও অজানা নয়। তাই তুলসীবাবু ছানাটাকে দু’হাত দিয়ে ধরে তাঁর ঝোলায় পুরেন। এই বিষয়টা প্রদ্যোতবাবু কে আরো আশ্চর্য করে। এই ছোট গল্পের পুরোটা জুড়ে প্রদ্যোতবাবু অসংখ্য জায়গাতে আশ্চর্য হন। কিন্ত তুলসীবাবু সেই নিরস নিরসই থাকেন। কিন্ত নিরাসক্ত অবস্থাতেও তিনি ‘চষ্ণু’ কে একবার ছেড়ে দিতে বনে যান। আরেকবার চষ্ণু-র খাদ্যভ্যাস পরিবর্তনের জন্য বনে যান। অর্থাৎ তিনি প্রকৃতির ব্যাপারে অতটা আগ্রহী না হলেও প্রকৃতির মায়া তাকে ঠিকই আবদ্ধ করে ফেলে। এটা অনেকটা অজান্তে ঘটে। আমরা দেখব, প্রকৃতির কিছু জিনিস হয়তবা আমাদেরকে বিরক্ত করে কিন্ত পরক্ষণেই মনে হবে যে এ জিনিসের সাথে হয়তবা আমি কোন মায়ার জালে আটকা পড়েছি। মানুষ জানে যে পাহাড় পর্বত, বন জঙ্গলে রয়েছে হাজারো বিপদ কিন্ত তারপরেও সে অভিযানে নামে শুধুমাত্র প্রকৃতিকে জানার জন্য আর নয়তো প্রকৃতির সাথে এক বন্ধন গড়ার জন্য।
প্রকৃতি অভিযান যেভাবে রহস্যের যোগান দেয়ঃ
আপনি একজন খুবই সাধারণ মানুষ। আপনার হয়তবা আলাদা কোন গুরত্ব নেই। অবসর জীবন কাটাচ্ছেন। আপনার এই অবসরের একঘেয়েমিতা কাটানোর সবচেয়ে ভাল উপায় প্রকৃতির মাঝে রহস্য খোঁজা। আর সেই রহস্যের সমাধান বের করা। সত্যজিৎ রায় তাঁর ‘ম্যাকেঞ্জি ফ্রুট‘ নামক গল্পে আমাদেরকে সে জিনিসই করিয়ে দেখিয়েছেন। নিশিকান্তবাবু মাস্টার তাঁর মাস্টারি লাইফ থেকে রিটায়ার্ড হওয়ার পর কবিরাজ দেখানোর জন্য চলে গেলেন করিমগঞ্জে তার বন্ধু তারক বাগচীর বাড়িতে। সেখানে গিয়ে কবিরাজের দেখা না পেলেও করিমগঞ্জের সুস্থ জল হাওয়ার লোভে থেকে গেলেন সেখানে।
তার বন্ধু ঘরকুনো মানুষ হলেও নিশিকান্তবাবু কিন্ত তা নন। তিনি নিয়মিত হেটে বেড়ান। একদিন এরকম হাটতে হাটতে তার নজর পরে ম্যাকেঞ্জি সাহেবের পরিত্যক্ত বাংলোর দিকে। বাংলোর চারদিকের গাছপালা দেখে তিনি বাংলোতে প্রবেশের লোভ সংবরন করতে পারেন না। লেখকের ভাষায়, “ নিশিকান্তবাবু গাছপালা ভালোবাসেন, বটানি তাঁর প্রিয় সাবজেক্ট ছিল কলেজে, বহরমপুরের বাড়িতে তাঁর নিজেরও একটি ছোট্ট বাগান ছিল । তাঁর উপর অনুসন্ধিৎসা তাঁর চরিত্রের একটা বিশেষ অঙ্গ। এত বিচিত্র ধরণের গাছ দেখে তিনি আর লোভ সামলাতে পারেননি।”
এরপর আর যা হল তিনি পাঁচিলের একটা ভাঙ্গা অংশ টপকে ম্যাকেঞ্জি সাহেবের বাগানে প্রবেশ করেন। বলতে পারেন তা এক রকম অনুপ্রবেশই ছিল। অনুপ্রবেশ না বলে বরং আমরা বলি ম্যাকেঞ্জি সাহেবের বাগানের গাছপালাই বরং নিশিকান্তবাবুকে টেনে নেন ! যাই হোক, এরপরই তো নিশিকান্তবাবু আবিষ্কার করে বসলেন দ্যা গ্রেট ম্যাকেঞ্জি ফ্রুট !
অর্থাৎ প্রকৃতির প্রতি সাধারণ মানুষের সাধারণ ভালোবাসা অনেক সময় সেই সাধারণ মানুষকে এমন কিছুর সন্ধান দিতে সক্ষম যা তাকে অসাধারণে পরিণত করতে পারে।
প্রকৃতিহীন দুনিয়াই মূল অপদার্থঃ
সত্যজিৎ রায়ের ছোট গল্পসমূহের মূল চরিত্রগুলোর একটি ধরণ হল তিনি চরিত্রগুলোকে খুব সাধারণ রাখার চেষ্টা করেছেন। না খুব জিনিয়াস, না খুব উচুদরের কোন ব্যক্তি। যাকে মানুষ সমীহ করে। সত্যজিতের গল্পে এরকম চরিত্রের দেখা খুব কমই পাবেন । তবে সত্যজিৎ রায় যতগুলো ছোট গল্প লিখেছেন এরমধ্যে সবথেকে সাধারণ থেকে সাধারণ বা বলতে পারেন অতি সাধারণ চরিত্রটি আমার নিকটে মনে হয়েছে ‘অপদার্থ‘ গল্পের সেজোকাকা চরিত্রটিকে। এমন একজন মানুষ যাকে কেউ গোনায় ধরে না। যার বেঁচে থাকা বা মরে যাওয়া কোনটাই আশপাশের মানুষের জন্য কোন গুরুত্ব বহন করে না। মানুষের তাচ্ছিল্য যেন তাকে আরো দূর্বল করে দেয়। সে নিজেই এক সময় বুঝতে পারে আমার কোন কদর এই পৃথিবীর মানুষের কাছে নেই। লেখকের কাকা মানসিকভাবে কতটা অসহায় হলে এরকমভাবে বলে, “ এটাও তো একটা , ব্যারাম তাই না ? গল্পের লেখক জিজ্ঞেস করেন , কোনটা ? কাকা বলেন, ‘ এই যে আমার দ্বারা কিচ্ছু হচ্ছে না, কিচ্ছু মনে থাকে না, কিচ্ছু মাথায় ঢোকে না, – এটা নিশ্চয়ই একটা রোগ’ ?
যাই হোক, গল্পের শেষের দিকে যান্ত্রিক ইটকাঠের শহর নিয়ে একটি অনুভূতি প্রকাশ করে সেজোকাকা। যে অনুভূতি লেখককে জানান দেয় যে তাঁর সেজোকাকা মূলত অপদার্থ নন তিনি দিব্যি একজন সুস্থ মানুষ বরং লেখক সহ পুরো দুনিয়াটাই পদার্থ।
সেজোকাকা লেখককে বলেছিলেন আফসোস করে , ‘ আমি ভাবলুম কলকাতায় গিয়ে একটু সোয়াস্তি মিলবে। জীবনের শেষ ক’টা দিন তবু আপনজনের সান্নিধ্যে কাটবে- তা এসব কি হচ্ছে বল তো? শকুনির ঠোকরে তো হাড় পাঁজরা বার করে দিয়েছে শহরটার। দিনে দশ ঘন্টা বিজলি নেই। শ্বাস টানলে ধোঁয়া- ধুলোয় প্রাণ অতিষ্ঠ। জিনিসপত্ররের যা দর, উদরের সাধ মিটিয়ে ভালমন্দ যে একটু খাব তারও জো নেই। – দূর দূর দূর – অপদার্থ, অপদার্থ।’
অর্থাৎ মানুষ যত সাধারণই হোক না কেন তাঁর অসাধারণ সেন্স তাকে জানান দেয় তাঁর চারদিকের প্রকৃতিহীন ইট কাঠের পৃথিবীই মূলত পুরো দুনিয়াটাকে অপদার্থ করে তুলছে। তাকে যতই অপদার্থ বলা হোক এই দুনিয়াকে যারা স্বাভাবিক মনে করে তারাই যেন আসল অপদার্থ।
‘কুটুম–কাটাম‘ গল্পে আমরা দেখতে পাই দিলীপ দুই সাধারণ গাছের ডাল কুড়িয়ে এনে বাড়িতে সাজিয়ে রাখতে গিয়ে এই দুই ডালের মাঝে কি অদ্ভুত সম্পর্কই না আবিষ্কার করে ফেলে। একটি ডাল আরেকটি ডালকে ছাড়া থাকতে পারে না। কান্নাকাটি করে। অর্থাৎ কত সাধারণ জিনিসের মধ্যে কত অসাধারণত্ব লুকিয়ে আছে তা ততক্ষণ পর্যন্ত জানা সম্ভব নয় যদি আপনি প্রকৃতির উপাদানকে ভালোভাবে অনুভব করতে না পারেন। প্রকৃতি রহস্য সৃষ্টি করবে অতঃপর একদিন আপনি নিজেই প্রকৃতির কল্যানে সেই রহস্য ভেদ করতে পারবেন । হয়তবা এই গল্পের চরিত্রের মত শেক্সপিয়রের সেই বিখ্যাত উক্তি আউড়াবেন- ‘ স্বর্গে মর্তে এমন অনেক কিছুই ঘটে , ‘হোরেশিও, যা তোমাদের দার্শনিকেরা স্বপ্নেও ভাবতে পারে না।’
প্রকৃতি কি স্মৃতি রোমন্থন করায় ?
অনেক সময় প্রকৃতি মানুষকে তার পুরানো স্মৃতিগুলোকে সামনে নিয়ে আসে। অতীত কে আবার নতুন করে জীবিত করে। অতীত সামনে এসে তাকে জানান দেয় অতীতের এই কাজগুলো তুমি না করলেও পারতে। মানুষের মাঝে আফসোসের অনুভূতি জাগায়। ‘ কাগ্তাড়ুয়া‘ গল্পে আমরা এরকম কিছুই দেখতে পাই। মৃগাঙ্কবাবুর গাড়িটা এমন এক স্থানে নষ্ট হয় যেখানে চারপাশে শীতের ফসল ফলানো হয়েছে। সুনসান এক নিরব পরিবেশ। যেখানে মৃগাঙ্কবাবুর নজর বারবার ঘুরেফিরে ঐ এক কাগ্তাড়ুয়ার দিকেই যাচ্ছে। কাগ্তাড়ুয়াটাই এক সময় এসে মৃগাঙ্কবাবুকে জানান দিল যে যে সোনার ঘড়ি চুরির অভিযোগে যাকে চাকরি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল সেই অভিরামই হল এই কাগ্তাড়ুয়া। অভিরাম এসে আবারো জানান দিয়ে গেল যে বাবুর ঘড়ি অভিরাম চুরি করেনি। বরং ঘড়িটি আলমারির নীচে পিছনের দিকে খোঁজ করলে পাওয়া যাবে। অভিরাম আরো জানান দিল যে, চাকরি চলে যাওয়ার পর তার আর কোন চাকরি করা হয়ে উঠেনি। কিছুদিনের মধ্যেই ব্যারামে পড়ে। সেই ব্যারামেই তার মৃত্যু হয়।
এমন সব আবার মৃগাঙ্কবাবুর ড্রাইভার চলে আসলে তাঁর ঘুম ভেঙ্গে যায়। সে বুঝতে পারে এতক্ষণ সে যা দেখছিলেন তাঁর সবটুকুই স্বপ্ন। কিন্ত সেই স্বপ্নই যেন মৃগাঙ্কবাবুকে জানান দিয়ে গেল যে সে কি ভুল করেছিল।
এছাড়া সত্যজিৎ রায়ের গল্প ‘মিঃ শাসমলের শেষ রাত্রি‘ গল্পে শাসমলের কাছে একে একে সেই সব প্রাণী এসে হাজির হয় যেগুলোকে শাসমল কোন কারণ ছাড়াই নির্মমভাবে হত্যা করেছিলেন। প্রথমে আসে কুকুর, তারপর আসে একটা বেড়াল, তারপর সাপ , পাখি কোনটাই বাদ যায় না। বিড়ালকে তিনি হত্যা করেছিলেন নৃশংসভাবে। বিড়ালের দোষ ছিল এই যে বিড়ালের কান্নায় নাকি তার ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল। একটি নেড়ি কুকুরকে হাইওয়েতে গাড়ি চালানোর সময় হাই স্পিডে গাড়ি চালিয়ে হত্যা করেছিলেন। এমনকি একটি সাপও তিনি মেরেছিলেন তার মামাবাড়িতে গিয়ে। সেই সাপটি এমনিতেই বাস্তুসাপ ছিল যা কখনো কারো অনিষ্ট করে নি। সেই সাপ এসেও শেষ পর্যন্ত হাজির হল। তাহলে প্রকৃতির সব উপাদানই এক এক করে হাজির হয়ে মনে করিয়ে যাচ্ছে মিঃশাসমলকে যে তার পাপের ভার কতটা জগদ্দল হয়ে উঠেছে যার ভারে আজ রাতই হয়তবা শেষ রাত হতে যাচ্ছে তার।
লেখকের প্রকৃতি বন্দনা সাহিত্য দুনিয়ায় নতুন কিছু নয়। কিন্ত সত্যজিতের গল্প পড়তে গিয়ে প্রকৃতি যে উপভোগের বিষয় এবং সেই উপভোগের অধিকার যে সকলেরই বাই বর্ন অধিকার এটাই যেন আমার নিকট বারবার মনে হয়েছে। অর্থাৎ মানুষ যদি তার কাজের জন্য একঘেয়েমি হয়ে পড়ে তাহলে মনে রাখা দরকার সেই একঘেয়েমিতা সমাজের সব মানুষের ক্ষেত্রেই সমান। আর তা কাটানোর জন্য প্রকৃতির কোলে আশ্রয় নেওয়ার অধিকার সকলেরই আছে। প্রকৃতির সাধারণ অসাধারণ সব দিক উপভোগ্য। শুধু দরকার আমাদের অনুভূতিগুলোকে জাগ্রত করার। জাগ্রত অনুভূতিতে প্রকৃতি ধরা দিবে উপশম হিসেবে। (সমাপ্ত)