সত্যজিৎ রায়ের ছোটগল্পে প্রকৃতির সাতকাহন (প্রথম পর্ব)
সত্যজিৎ রায় তার ক্ষণজন্মা জীবনে বেশ কিছু ছোট গল্প লিখেছেন। এই গল্পসমূহ নানা উপাদানের মিশেল। কিছু গল্পে হাসি পাবেন, কিছু গল্পে উদ্বেগের স্পর্শ পাবেন আবার কিছু গল্পে সুন্দর সমাপ্তি পাবেন। ছোট গল্পের শুরুতেই আপনি কল্পনা করতে পারবেন না যে রায় সাহেব কোথায় গিয়ে তাঁর গল্পের সমাপ্তি টানবেন। গল্পের শুরু আপনাকে শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাবে। এটা এক ধরণের মাদকতা ধরণের কিছু। যেন আপনি তার লেখার কৌশল জানেন কিন্ত তারপরেও ধরতে পারবেন না সে গল্প কোথায় গিয়ে শেষ করবে। ছোট গল্পে এরকম পরিবেশ সৃষ্টির জন্য তিনি বেশ কিছু উপাদান ব্যবহার করেন। কিছু উপাদান বারবার ঘুরেফিরে নানা গল্পে এসেছে। যেমন, আঁকা আকির কথা চিন্তা করা যাক। এই ছবি আঁকাকে কেন্দ্র করে সত্যজিৎ ছয়টি গল্প লিখেছেন। এছাড়া তিনি কিছু গল্পে স্থান দিয়েছেন অলীক ভয়ের। কিন্ত যে বিষয়টি নিয়ে এখানে আলোচনা করব তাহল রায় সাহেব তার ছোট গল্পে প্রকৃতিকে কিভাবে তুলে ধরেছেন ।
সত্যজিৎ রায় যে একজন প্রকৃতি প্রেমিক তা নতুন করে বলার কিছু নেই। তার প্রায় বড় ছোট প্রতিটি রচনাতে প্রকৃতিকে তিনি উপভোগ্যভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তার তৈরিকৃত প্রধান চরিত্রসমূহ ফেলুদা, তারিণীখুড়ো এবং প্রোফেসর শঙ্কু তিনজনের সাথেই প্রকৃতির সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। যা যেকোন পাঠক বুঝতে পারেন। এমনকি প্রকৃতিকে উদ্দেশ্য করে অসংখ্য বক্তব্যও রয়েছে এদের নিয়ে লেখা গল্প এবং উপন্যাসগুলোতে। কিন্ত সত্যজিতের ছোটগল্পগুলোতে প্রকৃতির অবস্থান ছিল কিছুটা ভিন্ন আঙ্গিকে। বড় উপন্যাস আর গল্পগুলোতে তিনি প্রকৃতিকে এনেছেন রহস্য খোঁজার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে। কিন্ত ছোটগল্পে তিনি শুধু রহস্যই আনতে চেয়েছেন বিষয়টা ওরকম নয়। সেখানে হয়তবা বাঙালি মধ্যবিত্ত আটপৌরে ব্যক্তিদের জন্য কিছু শিখাতে চেয়েছেন।হয়তবা প্রকৃতির সাথে কাব্যিক মিল না হোক অন্তত বেঁচে থাকার জন্য সামান্য উৎসাহ কিভাবে পাওয়া যায় তাই হয়তবা শিক্ষা দিয়েছেন। বর্তমান প্রবন্ধটি এ নিয়েই।
প্রকৃতি উপভোগ্য এবং তা সবার জন্যঃ
প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে অনেকেই গল্প লিখেছেন। তাদের গল্পে প্রকৃতির ছোট হতে ছোট বর্ণনাও পাওয়া যাবে। কিন্ত তা থাকে নির্দিষ্ট কিছু উদ্দেশ্য নিয়ে। যেমন ধরুন, অ্যালজারনুন ব্ল্যাকউডের (Algernoon Blackwood) ‘দা উইলো’ ( The Willow) নিয়ে কথা বলা যাক। এখানে লেখক উইলো বনের এবং এর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর খুব বিস্তারিত বর্ণনা করেন। কিন্ত তার এই বর্ণনার উদ্দেশ্য ছিল এই প্রকৃতির আবহাওয়াকে শেষ পর্যন্ত ভয়ে রূপ দেওয়া। এইচ পি লাভক্রাফট (H.P. Locecraft) প্রকৃতিকে নিয়ে কম গল্প লিখেন নি। কিন্ত প্রত্যেকটাই শেষে ভয়ের কারণে পরিণত হয়। অবশ্য উদাহরণে আনা দু লেখকই ভয়ের গল্প লেখার জন্য বিখ্যাত। যদি বিভূতিভূষনের গল্পও প্রসঙ্গক্রমে আনি তাহলে সেখানে দেখা যাবে প্রকৃতিকে তুলে ধরার জন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল । প্রকৃতি কাউকে কোলে পিঠে বড় করছে ভবিষ্যতের জন্য অর্থাৎ এখানে প্রকৃতিহীনা পটভূমিই কল্পনা করা সম্ভব নয়। কিন্ত সত্যজিৎ রায় কে নিয়ে যদি বলি তাহলে বলতে হয় তিনি প্রকৃতিকে ভয় থেকে আলাদা রেখেছেন তিনি প্রকৃতিকে ভয়ের কারণ বানান নি। এজন্য সত্যজিৎ কে ভয়ের গল্পের লেখক বলা মুশকিল। আবার তিনি প্রকৃতিকে মূল পটভূমিও বানান নি। তবে সত্যজিৎ যা করেছেন তাহল তিনি প্রকৃতিকে অতিসাধারণ মানুষের নিকট উপভোগ্য বানিয়েছেন। যেমন ধরুন, আমরা যদি আমাদের আশেপাশে তাকাই তাহলে অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় মানুষ হিসেবে ঐ মানুষগুলোকে খুঁজে পাব যারা নিজেদেরকে স্বাধীন ঘোষণা করে, অর্থবিত্তের নেই কোন অভাব , তাগড়া যুবক, অভিজ্ঞতার জন্য বিদেশ বিভূঁইয়ে ঘুরে বেড়ানো। নতুন নতুন অভিজ্ঞতা বাড়ানো। নানারকম অ্যাডভেঞ্চারে ঝাপিয়ে পড়ার জন্য সাধারণত আমরা এদেরকেই খুঁজে পাই।
কিন্ত ধরুন তো, কোন অফিসের মাছি মারা কেরানি সে প্রকৃতিকে উপভোগ করার জন্য একা একা বেরিয়ে যায় বা কোন গ্রামের অজপাড়াগাঁয়ের একজন সাধারণ শিক্ষক যাকে নিয়ে সবাই হাসি ঠাট্টা করে বেড়ায় তারো যে পৃথিবী দেখার স্বপ্ন থাকতে পারে তা সত্যজিতের গল্পে খুব চমকপ্রদভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এখানে কিছু উদাহরণ দেওয়া হল, ‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু‘ নামক গল্পে সত্যজিৎ এরকম এক চরিত্রই উপহার দিয়েছেন। গ্রামের এক সাধারণ শিক্ষক বঙ্কুবাবু । যাকে নিয়ে সবাই শুধু হাসি ঠাট্টা করে। যার প্রতিটি কথাকে ঠাট্টা এবং মূল্যহীন হিসেবে গ্রহণ করা হয়। সেই বঙ্কুবাবুর সাথে একদিন অ্যাং নামক এক এলিয়েনের দেখা হয়ে গেল। সেই অ্যাং বঙ্কুবাবুকে যখন জিজ্ঞেস করল , ‘ এমন কোনও জায়গা বা দৃশ্য আছে যা তোমার দেখতে ইচ্ছে করে , কিন্ত হয়ে উঠে না ?’
বঙ্কুবাবু তখন মনে মনে বলেন যে, ‘ সারা পৃথিবীটাই তো দেখা বাকি। ভূগোল পড়ান, অথচ বাংলাদেশের গুটিকতক গ্রাম ও শহর ছাড়া আর কি দেখেছেন তিনি? বাংলাদেশেরই বা কী দেখেছেন ? হিমালয়ের বরফ দেখেননি, সুন্দরবনের জঙ্গল দেখেননি, এমনকি শিবপুরের বাগানের সেই বটগাছটা পর্যন্ত দেখেননি।
মুখে বললেন, ‘অনেক কিছুই তো দেখিনি। ধরুন গরম দেশের মানুষ , তাই নর্থ পোলটা দেখতে খুব ইচ্ছে করে।’
তারপর আমরা যদি দেখি ‘টেরোড্যাকটিলের ডিম‘ নামক গল্পটি পড়ি তাহলে সেখানেও দেখতে পাই রায় সাহেব এক সাধারণ কেরানিকে মূল চরিত্রে নিয়ে এসেছেন। তার নাম বদনবাবু। তিনিও কল্পনাপ্রবণ। বদনবাবু অফিস শেষ করেই বাড়িতে ফেরেন না। তিনি একটু ঘুরাফেরা করে সন্ধ্যে ঘনিয়ে এলে তারপর বাড়িতে ফেরেন। সত্যজিৎ এভাবে উল্লেখ করেন বিষয়টি,
“দিনের মধ্যে একটা ঘন্টা অন্তত একটু চুপচাপ বসে থেকে কলকাতার যেটুকু খোলামেলা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আছে সেটুকু উপভোগ করা- এ না হলে বদনবাবুর জীবনই বৃথা। কেরানি হলেও কল্পনাপ্রবন তিনি। এই কার্জন পার্কেই বসে মনে মনে তিনি কত গল্পই ফেঁদেছেন। কিন্ত লেখা হয়ে ওঠেনি কোনদিন। সময় কোথায় ? লিখলে হয়তো নামটাম করতে পারতেন এমন বিশ্বাস তাঁর আছে।”
এরপর রায় সাহেবের লেখা অন্যতম সেরা ছোট গল্প ‘রতনবাবু আর সেই লোকটা‘ এখানে তিনি যদিও এক রহস্যময় চরিত্রের সূচনা ঘটান কিন্ত তাকেও তিনি একই সাথে একজন সাধারণ কেরানি এবং প্রকৃতি প্রেমিক হিসেবে রাখেন। সত্যজিৎ এখানে বলেন ,
” ভ্রমণ জিনিসটা রতনবাবুর একটা বাতিক বলেই বলা যেতে পারে। সুযোগ পেলেই তিনি কলকাতার বাইরে কোথাও ঘুরে আসেন । অবিশ্যি সুযোগ যে সবসময় আসে তা নয়, কারণ রতনবাবুর একটা চাকরি আছে। কলকাতার জিয়োলজিকাল সার্ভের আপিসে তিনি একজন কেরানি। আজ চব্বিশ বছর ধরে তিনি এই চাকরি করছেন। তাই বাইরে বেড়িয়ে আসার মত সুযোগ তাঁর বছরে একবারই আসে।”
এরপর আমরা যদি ‘ফ্রিৎস’– গল্পকে সামনে রাখি তাহলে অদ্ভুত একটা বিষয় দেখতে পাই। এখানে সত্যজিৎ রায় যে দুজনের কথা উল্লেখ করেছেন তাদের একজন একটি খবরের কাগজের সম্পাদকীয় বিভাগে চাকরি করেন আরেকজন ইস্কুল মাস্টারি। দু’বন্ধু মিলে রাজস্থান ভ্রমণে বের হয়েছে। দু’জনের একসাথে ছুটি পেতে সমস্যা হচ্ছিল কিন্ত অনেকদিনের তদবীর শেষে তা সম্ভব হয়েছে। দুজনের চাকরি জীবনে ব্যবধান থাকলেও বন্ধুত্ব অটুট টিকে রয়েছে। খবরের পত্রিকাতে যিনি চাকরি করেন অর্থাৎ জয়ন্ত তাঁর এখানে আসা আর দশটা মানুষের আসার মত নয়। জয়ন্ত এসেছেন রাজস্থানের বুন্দিতে। জয়ন্তর বাবা অনিমেষ দাশগুপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগে কাজ করতেন , তাই তাঁকে মাঝে মাঝে ঐতিহাসিক জায়গাগুলোতে ঘুরে বেড়াতে হত। সে হিসেবেই জয়ন্তের বুন্দি দেখা হয়ে যায়। সেখান থেকেই বুন্দির সাথে জয়ন্তের এক পুরানো সম্পর্ক রয়েছে। মূলত জয়ন্তের ঘুরতে পারাটা তার বাবার জন্য। তার বাবা সরকারি চাকরিজীবি হওয়ার কারণে সে এই সুযোগটা পেয়েছে। পরবর্তীতে জয়ন্ত যখন চাকরিজীবনে যায় সেই একত্রিশ বছর পরে এখানে বেড়াতে আসার জন্য মোক্ষম সুযোগ পাওয়াটা অনেক কঠিন হয়ে যায়। অর্থাৎ নিজ পিতা বা পরিবারের অবস্থানের দৌলতে অনেকের জন্যই প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করাটা যতটা সহজ হয় তা অন্যদের জন্য নাও হতে পারে।
একইভাবে ‘প্রোফেসর হিজিবিজবিজ‘ নামক গল্পতেও একজন লেখকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। যে গত তিন বছর ধরে অফিস থেকে কোন ছুটি পান নি। অবশেষে তিন সপ্তাহের ছুটি পেয়েই সে সমুদ্রের ধারে এক ছোট্ট শহরে গিয়ে উঠে।
তারপর ‘মৃগাঙ্কবাবুর ঘটনা‘ নামক গল্পেও এক সাধারণ মানুষের চরিত্র তুলে ধরা হয় যাকে তাঁর কলিগ সন্দেহ ঢুকিয়ে দিলে তিনি ছুটি নিয়ে কাশীতে চলে যান। এর আগে অবশ্য তিনি চিড়িয়াখানাতে যান। কিন্ত সেখানে গিয়ে তার কলিগের বক্তব্য আরো মজবুত হয়। এখানেও মৃগাঙ্কবাবুর কথা বলা হয় যে তিনি হার্ডিঞ্জ ইন্ডিয়া কোম্পানিতে কেরানিগিরি করেন।
‘ভক্ত‘– গল্পের অরূপবাবুও খুব সাধারণ একটি চাকরি করেন। যখন একদল ভক্ত অরূপবাবু কে কোন জনপ্রিয় সাহিত্যিকের সাথে গুলিয়ে ফেলছেন তখন অরূপবাবু বাধ্য হয়ে নিজের পরিচয় এভাবে তুলে ধরেন , “ আমি শিশুসাহিত্যিক নই। আমি কোনও সাহিত্যিকই নই। আমি লিখিই না। আমি ইনসিওরান্সের আপিসে চাকরি করি। নিরবিলিতে ছুটি ভোগ করতে এসেছি, আপনারা দয়া করে আমাকে রেহাই দিন”।
সরল মানুষের সরল প্রেমঃ
অতি সাধারণ মানুষদের এক বুঝ হল যে, প্রকৃতি দেখা এবং ঘুরাফেরা করে মনের তৃপ্তি দেওয়ার জন্য বিশাল অঙ্কের টাকার মালিক হওয়া প্রয়োজন। কিন্ত সত্যজিৎ রায় সাহেব এই বিষয়টিকে অনেক সাধারণভাবে রেখেছেন। একজন কেরানির পক্ষে নিশ্চিতই সারা বিশ্ব গল্পের তরুণ যুবাদের মত দাপিয়ে বেড়ানো সম্ভব না। কিন্ত এই বলে কেরানিরা ঘুরবে না ? তাই এদের ঘোরাঘুরিটাও তিনি অনেক যত্নের সাথে অতি সাধারণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। যা কিছু উদাহরণ দিলে পরিষ্কার হবে।
‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু‘ গল্পে বঙ্কুবাবু যে জিনিসগুলো দেখেন নি তার মধ্যে একটি ছিল ‘শিবপুর বাগানের সেই বটগাছ’ ! অর্থাৎ এখানে রায় সাহেব বটগাছের নামটি যেভাবে তুলে ধরেছেন তাতে বুঝা যায় যে এটি পার্শ্ববর্তী গ্রামের উল্লেখযোগ্য কোন গাছ যা এখনো বঙ্কুবাবুর পক্ষে দেখা হয়ে উঠেনি। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের ‘বাকেট লিস্টে’ সাধারণ কিছু থাকাটাই স্বাভাবিক। এখানে মূল বিষয় হল আমার বাকেট লিস্টে ‘অজানা’ কে ‘জানা’-র শখ আছে কিনা। তা হতে পারে পাশের গ্রামের কোন গাছ অথবা আরেক মহাদেশের অজানা কোন প্রকৃতি যার সাথে এখনো পরিচয় হয়ে উঠেনি।
এরপর ‘টেরোড্যাকটিলের ডিম‘ নামক গল্পতেও রায় সাহেব কে দেখবেন তিনি অফিস শেষে কলকাতার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যতটুকু বাকি আছে ততটুকুই দেখে মনে স্বস্তি আনতে চান। এবং সেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখেই তিনি নানা গল্প বানান। এর চেয়ে স্বস্তিমূলক চাওয়া আর কি হতে পারে। তাঁর সেই প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখাতে কেউ এসে বাধা দিলে বা কারো উপস্থিতিতে তিনি বাধাগ্রস্ত হলে তখন আবার তিনি বিরক্ত হন। অর্থাৎ নিম্নপদস্থ এক কর্মচারীর সাধারণত অফিসের ভিতরে বসদের কথা শুনে উঠবস করা ছাড়া আর কিছু করার উপায় থাকে না। কিন্ত সে যখন বাহিরে এসে প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে নিজ কল্পনাজগতে প্রবেশ করে তখন সেখানকার বস তিনি নিজেই হয়ে যান। সেই সুখকর কল্পনা যখন বাধাগ্রস্ত হয় তখন তো বিরক্তি আসাটাই স্বাভাবিক।
‘সদানন্দের খুদে জগৎ’ গল্পে আমরা কৈশোরে পা দেওয়া এক বালকের প্রকৃতির প্রতি অদ্ভুত ভালোবাসা দেখতে পাই। সে নিজেও স্বীকার করে যে সে যেসব জিনিসে মজা পায় , সেসব জিনিস হয়তো বেশির ভাগ লোকের চোখেই পড়ে না। সদানন্দ এভাবে তার অদ্ভুত ভালোবাসা তুলে ধরে, “ যেমন ধরো, তুমি হয়তো কিছু না-ভেবে মাটিতে কাঠি পুঁতেছ , আর হঠাৎ দেখলে একটা ফড়িং খালি খালি উড়ে উড়ে এসেই কাঠির ডগায় বসছে- এটা তো ভীষণ মজার ব্যাপার !……আসল কথা কি জানো ? আমি যেসব জিনিসে মজা পাই , সেসব জিনিস হয়তো বেশির ভাগ লোকের চোখেই পড়ে না। আমার বিছানায় শুয়ে শুয়েই তো কত মজার জিনিস দেখি আমি। মাঝে মাঝে জানলা দিয়ে শিমুলের বিচি ঘরে উড়ে আসে। তাতে লম্বা রোঁয়া থাকে , আর সেটা এদিক-ওদিক শূন্যে ভেসে বেড়ায় । সে ভারী মজা। একবার হয়তো তোমার মুখের কাছে নেমে এল, আর তুমি ফুঁ দিতেই হুশ করে চলে গেল কড়িকাঠের কাছে।
আর জানলার মাথায় যদি একটা কাক এসে বসে, তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে তো ঠিক যেন মনে হয় সার্কাসের সং। আমি তো কাক এসে বসলেই নড়াচড়া বন্ধ করে কাঠ হয়ে পড়ে থাকি, আর আড়চোখ দিয়ে কাক বাবাজির তামাশা দেখি।”
সদানন্দের চরিত্র রূপায়ন করে সত্যজিৎ বুঝিয়েছেন প্রকৃতির সৌন্দর্য এবং মর্ম বুঝার জন্য সবসময় যে ভ্রমণই করতে হবে বিষয়টি এরকম নয়। মানুষ চাইলে প্রকৃতিকে হয়তবা নিজ প্রকোষ্ঠের মধ্যে থেকেই উপভোগ করতে পারে। প্রকৃতির উপাদানের সংখ্যাতো কম নয়। অজস্র উপাদান । সেই অজস্র উপাদানের দু একটা তো আমাদের চারিপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়েই থাকে। চাইলে তো এগুলো দেখেই নিজের নিস্তেজ জীবনে কিছুটা হলেও সুখের আবরণ দেওয়া সম্ভব। রায় সাহেবের সদানন্দ হাসপাতালে গিয়েও নিস্তেজ হয় না। সে সেখানে উপভোগ করে পিপড়ের কর্মকান্ড। মানুষের জীবন কত সাধারণ অথচ আমরা তাঁকে কত জটিল বানাই। সবসময় পকেটের টাকা খরচ করেই যে এ আনন্দ উপভোগ করতে হবে একথা কে বলল ! দেখ সদানন্দকে সে তো পিপড়েদের কে নিজের বন্ধু বানিয়ে ছেড়েছে !
‘অনাথবাবুর ভয়’ নামক গল্পে সাধারণ মানুষ ঘুরতে গেলে তার আকাঙ্খিত বিষয় কি থাকে তা রায় সাহেব গল্পকারের ভাষাতে চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন । গল্পকার রঘুনাথপুর বেড়াতে যান। কিন্ত কেন রঘুনাথপুর বেড়াতে যাচ্ছেন সে ব্যাপারটি এভাবে তুলে ধরেন ‘কলকাতায় খবরের কাগজের আপিসে চাকরি করি। গত ক’মাস ধরে কাজের চাপে দমবদ্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। তা ছাড়া আমার লেখার শখ, দু-একটা গল্পের প্লটও মাথায় ঘুরছিল, কিন্ত এত কাজের মধ্যে কি আর লেখার ফুরসত জোটে ? তাই আর সাত-পাঁচ না ভেবে দশদিনের পাওয়া ছুটি আর দিস্তেখানেক কাগজ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
এত জায়গা থাকতে রঘুনাথপুর কেন তারও অবিশ্যি একটা কারণ আছে। ওখানে বিনা-খরচায় থাকার একটা ব্যবস্থা জুটে গেছে। আমার কলেজের সহপাঠী বিরেন বিশ্বাসের পৈতৃক বাড়ি রয়েছে রঘুনাথপুরে……………’ অর্থাৎ গল্পকার যে তার ব্যস্ত জীবন থেকে নিঃশ্বাস ফেলতে রঘুনাথপুরে এসেছেন তার অন্যতম একটি কারণ হল ভাগ্যক্রমে বিনা খরচে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে যাওয়া। বাঙ্গালি মধ্যবিত্তরা তার চাকরি জীবন থেকে কয়েকটা দিন ফুরসৎ পেলেও টাকা খরচ হয়ে যাবে এই ভয়ে তারা ঘুরতে বের হন না। এরকম এক ভয় সব মধ্যবিত্তদের মধ্যে কাজ করে। একেতো এরা কর্মজীবনে অতটা স্বাধীন নয় যে যখন ইচ্ছে তখন ছুটি নিয়ে বের হতে পারবে। দুই হল এদের পকেটে যতটুকু সম্বল থাকে তা যাওয়া আসাতেই খরচ হয়ে যায়। মাঝখানের পথটুকু টাকা শেষ হয়ে যাওয়ার আফসোসে কাটে। তাই ভাগ্য যদি সহায় হয় তাহলে নিকট সজন অথবা বন্ধু বান্ধবদের কারণে ফ্রি থাকা খাওয়ার একটা ব্যবস্থা হয়। তখন আসলে সমতলে বেড়িয়ে পাহাড়ে বেড়ানোর স্বাদ পাওয়া যায়। রায় সাহেব বাঙ্গালিয়ানার এক অদ্ভুত এবং বাস্তব দিক তুলে ধরেছেন।
তারপর রায় সাহেব ‘রতনবাবু আর সেই লোকটা‘ গল্পতেও রতনবাবুর খুব সহজ সরল চাওয়া তুলে ধরেছেন । রতনবাবুর কলিগ রতনবাবুর উপর ভারী বিরক্ত কেননা রতনবাবু ঘুরতে যাওয়ার জন্য এমন সব অদ্ভুত জায়গা বাছাই করেন যা সাধারণত মানুষ ঘুরতে যাওয়ার জন্য বাছাই করেন না। তিনি রতনবাবুকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “ আপনার পছন্দর সঙ্গে আমার পছন্দ কি মিলবে ? আপনি যাবেন সব উদ্ভট নাম-না-জানা জায়গায়। সেখানে না আছে দেখবার কিছু , না আছে থাকা-খাওয়ার সুবিধে। আমায় মাফ করবেন।”
একা একা ঘুরতে যেয়েও যে উপভোগ করা যায় তার উত্তম উদাহরণ হল এই রতনবাবু। রতনবাবু কিভাবে উপভোগ করেছেন সেই দৃশ্যটা সত্যজিৎ রায় এভাবে তুলে ধরেছেন, ‘ শহর থেকে বেরোলেই খোলা অসমতল প্রান্তর। তার মধ্য দিয়ে আবার এদিক ওদিক হাটা-পথ চলে গেছে। এই পথের একটা দিয়ে মাইলখানেক গিয়ে রতনবাবু একটা ভারী মনোরম জিনিস আবিষ্কার করলেন। একটা ছোট্ট ডোবা পুকুর, – তার মধ্যে কিছু শালুক ফুটে আছে , আর তার চারিদিকে অজস্র পাখির জটলা। বক, ডাহুক, কাদাখোঁচা , মাছরাঙা- এগুলো রতনবাবুর চেনা; বাকিগুলো এই প্রথম তিনি দেখলেন।
প্রতিদিন বিকেলবেলাটা এই ডোবার ধারে বসেই হয়তো রতনবাবু বাকি ছুটিটা কাটিয়ে দিতে পারতেন , কিন্ত দ্বিতীয় দিন আরও কিছু আবিষ্কারের আশায় রতনবাবু অন্য আরেকটা পথ দিয়ে হাটতে শুরু করলেন।’
এরপর ‘প্রোফেসর হিজিবিজবিজ‘ গল্পতেও গল্পকথক এমন স্থানে ঘুরতে আসে যা সাধারণ মানুষের নিকট পরিচিত হলেও এটা ছিল অফ সিজনে ঘুরতে আসা। সেখানে বলা হয়, ‘ উড়িষ্যার গঞ্জম ডিসট্রিক্টে বহরমপুর স্টেশন থেকে দশ মাইল দূরে সমুদ্রের ধারে একটি ছোট্ট শহর গোপালপুর। গত তিন বছর আপিসের কাজের চাপে ছুটি নেওয়া হয়নি। এবার তিন সপ্তাহের ছুটি নিয়ে এই না-দেখা অথচ নাম-শোনা জায়গাটাতেই যাওয়া স্থির করলাম’। একটু পরে আবারো বলা হয়, ‘ গোপালপুরে আগে কখনও আসিনি। বাছাইটা যে ভালই হয়েছে সেটা প্রথমদিন এসেই বুঝেছি। এমন নিরিবিলি অথচ মনোরম জায়গা কমই দেখেছি। নিরিবিলি আরও এইজন্য যে, এটা হল অফ সীজন- এপ্রিল মাস।
‘ভক্ত’ -গল্পতেও অরূপবাবুর খুব সাধারণ প্রকৃতিপ্রেম তুলে ধরা হয়েছে। যদিও তিনি বেড়াতে এসেছেন পুরীতে কিন্ত সত্যজিৎ রায় এখানে তারপরও অরূপবাবুর প্রকৃতির প্রতি অতি সাধারণ ভালোবাসাটুকু তুলে ধরেছেন এভাবে, ‘ কলকাতায় তাঁকে দেখলে কেউ ভাবুক বলে মনে করবে না। তা না করুক। অরূপবাবু নিজে জানেন তাঁর মধ্যে এককালে জিনিস ছিল। সেসব যাতে কাজের চাপে একেবারে ভোঁতা না হয়ে যায় তাই তিনি এখনও মাঝে মাঝে গঙ্গার ধারে , ইডেন বাগানে গিয়ে বসে থাকেন, গাছ দেখে জল দেখে ফুল দেখে আনন্দ পান, পাখির গান শুনে চিনতে চেষ্টা করেন সেটা দোয়েল না কোয়েল না পাপিয়া। অন্ধকারে অনেকক্ষণ ধরে একদৃষ্টে সমুদ্রের দিকে চেয়ে থেকে তাঁর মনে হল যে, ষোলো বছরের চাকরি জীবনের অনেকখানি অবসাদ যেন দূর হয়ে গেল।’
এখানেই আসলে প্রকৃতি প্রেমের অস্তিত্ব ধরা দেয়। যা মানুষের ক্ষত, ক্লান্তি , অবসাদ, হতাশা কে দূর করে দেয়। মানুষ তখন নিজের অস্তিত্ব কে বুঝতে শেখে। নিজের স্বাধীন সত্ত্বা ধরা দেয়। সত্যজিৎ মধ্যবিত্ত বাঙালির জীবনের কষ্ট কোথায় তিনি তা স্পষ্টই ধরতে পেরেছেন। আর এই কষ্ট, একঘেয়েমিতা দূর করার উপায়ও যেন বাতলে দিয়েছেন খুব অল্প কথাতে।
চলবে-
দ্বিতীয় অর্থাৎ শেষ পর্ব টি পড়তে ক্লিক করুন এখানে- সত্যজিৎ রায়ের ছোটগল্পে প্রকৃতির সাতকাহন (দ্বিতীয় অর্থাৎ শেষ পর্ব)