গাযা যুদ্ধ নিয়ে যে কারণে পরিবেশবাদীদের সরব হতে হবে
গাযাতে ইসরায়েল গণহত্যা পরিচালনা করছে এটা নতুন কোন কথা নয়। যুদ্ধের শুরু থেকেই ইসরায়েলী বাহিনীর হামলা এবং যুদ্ধাস্ত্র পরিচালণার প্রতিটা দিক গণহত্যার প্রমাণ বয়ে নিয়ে চলেছে। সম্প্রতি এ নিয়ে ICJ তে সাউথ আফ্রিকার মামলা চলমান রয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই যে যুদ্ধে গণহত্যা চলছে সে যুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলতে আলাদা কোন ইনডেক্সের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। তারপরেও আমরা পরিবেশবাদীদের বিভিন্ন সময়ে দেখি তারা যুদ্ধের ব্যাপারে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন। একটি হাতি বা একটি গন্ডার শিকার করা হলে তাদের টুইটারের মঞ্চ যেভাবে কেঁপে উঠে ঠিক একইভাবে একজন মানুষ কিংবা এক হাজার জন মানুষ মারা গেলেও তা নিয়ে তাদের কোন কথা বলতে আমরা দেখি না। হয়তবা তারা বিষয়টিকে এরকম মনে করে থাকতে পারে যে মানুষ হত্যার সাথে সরাসরি এনভায়োরনমেন্টাল কস্ট বা পরিবেশের ক্ষতির সম্পর্ক নেই। এ কারণেই হয়তবা গাযা যুদ্ধের পরপর গ্রেটা থানবার্গ এক ক্লাইমেট র্যালী–তে প্যালেস্টাইনের পক্ষে কথা বলতে আরম্ভ করলে তাকে বাঁধা দেওয়া হয়। কদিন পরেই জার্মান সাময়িকী ‘স্পিগেলে‘ এ নিয়ে বিশাল এক লেখা চলে আসে যার ভাষ্য হল গ্রেটা ক্লাইমেট র্যালীতে প্যালেস্টাইনের পক্ষে কথা বলে ক্লাইমেট আন্দোলনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে !
তবে এরকম পরিবেশবাদীদের নিকট আমি অনুরোধ করব আপনারা গাযাতে মানুষ হত্যা নিয়ে চিন্তা না করতে চাইলেও বা একে হুমকি মনে না করলেও মানুষকে হত্যা করতে গিয়ে ইসরায়েলী বাহিনী যেভাবে তাদের যুদ্ধাস্ত্রের পরিচালণা করছে তা সরাসরিই পরিবেশের জন্যও ক্ষতি হিসেবে দেখা দিচ্ছে। সম্প্রতি এক গবেষণাতে এ বিষয়গুলো উঠে আসে। গবেষণাতে উল্লেখ করা হয় যে গাযা যুদ্ধের প্রথম দু মাসে ২৮১,৩১৫ মেট্রিক টন কার্বন নিঃসরণ হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে F-16 দিয়ে গাযাতে বোমা ফেলার জন্য ইসয়ায়েলী বাহিনীর প্রতিদিনের প্রায় তিনশ ঘন্টার ফ্লাইট যাত্রা। তারপর আমেরিকার সাপ্লাই ফ্লাইট ।এছাড়া অন্যান্য আর্টিলারি শেল থেকে কার্বন নিঃসরণও এখানে ধরা হয়েছে।
এছাড়া সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে যে বিল্ডিং সমূহ বোম্বিং করে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে তা যদি পূনরায় নির্মান করতে হয় তাহলে সেখানে প্রায় ৩০,০০০,০০০ মেট্রিক টন কার্বন নিঃসরণ হবে বলে গবেষণা পত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। যা অনেক আধুনিক রাষ্ট্র যেমনঃ সুইজারল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড এর বাৎসরিক কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ থেকেও বেশি।
প্রথম ষাট দিনের যুদ্ধে ইসরায়েলী বাহিনী যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ করেছে তা ১৫০,০০০ টন কয়লা পুড়ানোর সমান।
ভারতীয় পত্রিকা ‘The Hindu’ নভেম্বর মাসে এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে যে ২০০০ পাউন্ডের MK-84 বোমা যখন বিস্ফোরিত হয় তখন এর ভিতরে থাকা অ্যালুমিনিয়ামের একটি অংশ এবং TNT এর বাকি অংশ সমূহ চারিদিকে ছড়িয়ে যায়। যা একই সাথে মাটি, পানি এবং বায়ুর সাথে মিশে যায়। গাযার একমাস যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি সিরিয়ার চার বছরের যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির সমান।
এছাড়াও ইসরায়েল এ যুদ্ধে এরকম কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে যা সরাসরি বাস্তুতন্ত্রকেও হুমকির মধ্যে ফেলে। দ্যা হিন্দু–তে উল্লেখ করা হয় যে ২০১২ সালের বই Challenging Post-Conflict Environments এ লেখা হয় যে দ্বিতীয় ইন্তিফাদা (২০০০–২০০৫)-র সময় ইসরায়েলী বাহিনী অভিযোগ করে যে প্যালেস্টিনিয়ানরা ওলিভ গাছকে তাদের যুদ্ধের জন্য ব্যবহার করে। তারা অলিভ গাছের আড়ালে লুকিয়ে থেকে ইসরায়েলীদের উপর হামলা করে। এ কারণে ইসরায়েলী বাহিনী অলিভ গাছ ধ্বংস করার জন্য শিকড় সহ তুলে ফেলা এবং পুড়িয়ে দেওয়া সহ আরো অনেক পথ অবলম্বন করে। প্যালেস্টিনিয়ান মিনিস্ট্রি অফ অ্যাগ্রিকালচারের দেওয়া তথ্যমতে ইন্তিফাদা–র প্রথম বছরেই ইসরায়েলী বাহিনী এবং এর অধিবাসীদের (সেটলার) দ্বারা ৩.৭৪ লাখ অলিভ গাছ ধ্বংস হয়।
এছাড়া ফিলিস্তিনের ভূমি যেন ফসল ফলানোর জন্য অনুপযুক্ত হয়ে উঠে সে চেষ্টাও ইসরায়েলী বাহিনীর রয়েছে। ২০১৯ সালে ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডনের এক গবেষণাতে উল্লেখ করা হয় যে ইসরায়েলী বাহিনী যুদ্ধের সময় ঘোষণা ছাড়াই শস্য নষ্ট করার জন্য স্প্রে করে। এবং ইসরায়েলের মিনিস্ট্রি অফ ডিফেন্স এ রিপোর্টটি যারা করে তাদেরকে এ ব্যাপারে কনফার্মও করে যে তারা এই কাজটা বিশেষ করে শস্য ফলানোর সময় ( অক্টোবর–নভেম্বর) করে থাকে। এখানে glyphosphate, Oxyflurofen এবং Diuron ব্যবহার করা হয়। European Chemicals Agency গ্লাইফসফেট এর ব্যাপারে মন্তব্য করে যে এ জিনিস চোখ নষ্ট করে দিতে পারে এবং একই সাথে জলজীবি প্রাণীদেরকেও মেরে ফেলতে পারে। Oxyflurofen ত্বক এবং চোখে চুলকানির জন্ম দিতে পারে এবং একে অবশ্যই পানির উৎস থেকে বিশেষ করে পানি প্রবাহের উৎস এবং নালাতে ছিটানোর ব্যাপারে বিরত রাখতে হবে। আর Diuron উদ্ভিদের ফটো সিনিথেসিস প্রক্রিয়া কে বন্ধ করে দেয়।
এছাড়া ডিসেম্বর মাসের গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে উঠে আসে যে গাযাতে জ্বালানি সামগ্রীর অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ঘর বাড়ির দরজা– জানালা পুড়িয়ে দেওয়ার পর যখন আর কোন কিছুই অবশিষ্ট নেই তখন বাধ্য হয়ে গাযাবাসী নিজেদের রান্নার কাজে গাযার অবশিষ্ট গাছপালা সমূহ কেটে ফেলতে বাধ্য হচ্ছে। গাযা যে পুরো বৃক্ষবিহীন মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে এর পুরো দায়টাই কিন্ত ইসরায়েলের।
মূল কথা হল গাযা যুদ্ধকে আপনি যেভাবেই দেখেন না কেন এ যুদ্ধ যে সরাসরি পরিবেশের জন্য হুমকি তা নিয়ে সন্দেহ করার বিন্দুমাত্র উপায় নেই। আপনি পরিবেশের যে দিকটির ব্যাপারে চিন্তা করে নিজের সহ পুরো জাতির লাইফ স্টাইল পরিবর্তনের কথা ভাবছেন অর্থাৎ গ্লোবাল ওয়ার্মিং কমিয়ে আনা এবং জলবায়ু আন্দোলন কে সফল করা সেই দিকসমূহকেই বর্তমান গাযার যুদ্ধ এক বিশাল প্রশ্নের সামনে দাড় করিয়ে দিয়েছে। যা আপনি এড়াতে পারবেন না। এবং এ যুদ্ধের জন্য যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হচ্ছে তার জন্য সরাসরি দায়ী হল ইসরায়েল এবং আমেরিকা। কেননা নিরীহ মানুষদের মারার জন্য যে বোমা ফেলা হচ্ছে তার সর্বশেষ গন্তব্যস্থল গাযা হলেও তা আমেরিকা থেকে এ পর্যন্ত উড়িয়ে এনে মানুষ হত্যা পর্যন্ত যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হচ্ছে তা আপনি কিভাবেই বা এড়িয়ে যাবেন।