সাপ তাহলে শুনতে পায় !
সাপ তাহলে শুনতে পায় !
হাঁ। সাপ শুনতে পায়। যদিও এতদিন মনে করা হত সাপ শুনতে পায় না এবং সাপের চলাফেরা শুধুমাত্র ঘ্রাণ শক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং সাপ শুনতে পারার বিষয়টিকে ‘মিথ‘ হিসেবে সাব্যস্ত করা হত। কিন্ত সম্প্রতি PLOS ONE এ প্রকাশিত এক গবেষণাতে সাপের শুনতে পারার বিষয়টি সামনে আসে। কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকেরা মূলত এ গবেষণাটি পরিচালনা করেন। গবেষণা টিমে রয়েছেন কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটির ভেনোম ইভোলিশন ল্যাবের অন্যতম গবেষক ক্রিস্টিনা (Cristina N. Zdenek) এছাড়াও আছেন অস্ট্রেলিয়ান রেপটাইল একাডেমির ( Australian Reptile academy)-র ক্রিস (Chris Hay) , এছাড়াও কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটির আরো তিনজন গবেষক যথাক্রমে টিমোথি স্ট্যাপলস ( Timothy Staples) , ল্যাচলান এন বুর্ক ( Lachlan N. Bourke) এবং ডেমিয়েন কানডুসো (Damian Candusso).
তারা মোট পাঁচটি বর্গের (genus) উনিশ–টি সাপ নিয়ে ৩০৪ টি নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষা চালান। পরীক্ষাসমূহ তারা করেন সাউন্ডপ্রুফ রুমে। তারা তিন ধরণের সাপদের উপর তিন ধরণের শব্দ প্রয়োগ করে বিষয়টি পর্যবেক্ষন করেন। তারা যে তিন ধরণের সাউন্ড প্রয়োগ করেন তাহল (0-150Hz) যা ভূমিতে কম্পনের সৃষ্টি করে, (150-300Hz) যা ভূমিতে কোন কম্পনের সৃষ্টি করে না, এবং (300-450 Hz) এই শব্দও ভূকম্পন সৃষ্টি করে না। এরকম তিন ধরণের শব্দ প্রয়োগ করে তারা সাপেদের মধ্যকার প্রতিক্রিয়া রেকর্ড করেন। তারা পর্যবেক্ষন করেন যে সাপেদের প্রতিক্রিয়া প্রজাতি ভেদে ভিন্ন হয়।
বাতাসের মাধ্যমে ভেসে আসা শব্দের সাথে সাপের আচরণ কেমন ?
সাধারণ ধারণা হল, শব্দের দ্বারা ভূমিতে সৃষ্ট কম্পনের দ্বারা সাপ অনুভূত হয় । এবং সে অনুভূতি কাজে লাগিয়ে সাপ চলাফেরা করে। কিন্ত গবেষকেরা এখানে বিশেষভাবে দেখতে চান যে , ভূমিতে কম্পন সৃষ্টি হয় না এরকম শব্দের সাথে সাপের আচরণ কেমন হতে পারে। নির্দিষ্ট শব্দ বা সাউন্ডের উপর একেক সাপের একেক রকম প্রতিক্রিয়া তারা দেখতে পান। বিশেষ করে Woma Python (Aspidites ramsayi) শব্দের সাথে সাথে তাদের নড়াচড়া উল্লেখযোগ্য হারে বাড়িয়ে দেয়। এছাড়া ডেথ অ্যাডার ( Death Adder; Sci: Acanthophis antarctius), তাইপান ( taipan; Sci: Oxyuranus) , ব্রাউন স্নেক ( Brown Snake; Sci: Pseudonja)- র ক্ষেত্রে দেখা যায় যে তারা শব্দের উৎসমূল থেকে সড়ে আসে এবং তাদের আচরণের মধ্যে এড়ানো পরিলক্ষিত হয়।
তাইপানের ক্ষেত্রে দেখা যায় তারা উল্লেখযোগ্যভাবে তাদের আত্মরক্ষামূলক আচরণ প্রকাশ করতে থাকে। সাপ স্তন্যপায়ী প্রাণী হতে শুরু করে অন্যান্য সরীসৃপদের নিকটেও খুবই সংবেদনশীল। তাই শ্রবনেন্দ্রিয় স্বাভাবিকভাবেই সাপের জন্য এক গুরুত্বপূর্ন ইন্দ্রিয়।
বাতাসে ভেসে আসা শব্দের কারণে সাপের মধ্যে যে বৈশিষ্ট্যসমূহ প্রকাশ পায়ঃ
শব্দের জন্য সাপেরা আত্মরক্ষা এবং সাবধান হওয়া ছাড়াও আরো যে বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকাশ করে; থেমে যাওয়া ( Freezing) , শব্দ করা ( hissing), কুন্ডলী পাকানো ( fixation), মাথা দোলানো ( head jerks), হাঁ করা ( Lower Jaw drops) , মাথা দাঁড় করানো ( Periscoping) এবং সতর্কতামূলক উৎস (শব্দের) সম্পর্কে জানার চেষ্টা করা ( cautionary exploration)। Woma Python (Aspidites ramsayi) সাপকে আশ্চর্যজনকভাবে শব্দের উৎসের দিকে এগোতে দেখা যায়। এরকমভাবে সে তার মাথাকে দাঁড় করায় যেন মনে হয় সে শব্দের উৎস কোথা থেকে আসছে এটা সে দেখার চেষ্টা করছে বা ভালোভাবে বুঝার চেষ্টা করছে । একে Periscoping বা মাথা দাঁড় করানো বলা যায়। এছাড়া আরো তিন টি বর্গের (genus) সাপকে ডেথ অ্যাডার ( Death Adder; Sci: Acanthophis antarctius), তাইপান ( taipan; Sci: Oxyuranus) , ব্রাউন স্নেক ( Brown Snake; Sci: Pseudonja) শব্দের উৎস থেকে সড়ে আসতে দেখা যায়। ডেথ অ্যাডার সাধারণত অতর্কিতভাবে আক্রমন করে শিকার করে। অর্থাৎ সে নির্দিষ্ট জায়গাতে শিকারের অপেক্ষায় অনেকক্ষন বসে থাকে। অন্যান্য সাপের তুলনায় ডেথ অ্যাডার একটু ধীরে ধীরে চলাচল করে তাই এটা স্বাভাবিক যে বড় কোন শব্দ তার নিকট পৌছালে সে শব্দের উৎস থেকে দূরে সড়তে চাইবে।
আপনি যতই বিষধর হন না কেন নিশ্চয়ই চাবেন না ক্যাঙ্গারু বা ওমব্যাটের মত প্রানীরা এসে আপনাকে মাড়িয়ে দিয়ে যাক। অন্যদিকে ব্রাউন স্নেক এবং তাইপান শিকার খুজে বেড়ানো সাপ হলেও তারা শিকারী পাখি দ্বারা শিকার হতে পারে তাই তাদের জন্যও শব্দের ব্যাপারে সংবেদনশীল হওয়া স্বাভাবিক।
সাপ কি মানুষের শব্দ শুনতে পায় ?
এ সম্পর্কে এই গবেষণার নেতৃত্বদানকারী সদস্য ক্রিস্টিনার (Cristina N. Zdenek) বক্তব্য হল, আমাদের গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল বহুল প্রচলিত বিশ্বাস যে সাপ বধির বা শুনতে পায় না তার আসল অবস্থা নির্ণয় করা। তারা শুনতে পায় কিন্ত আমাদের মত ভালো শুনতে পায় না। তারা নিম্ন কম্পাঙ্কের শব্দ শুনতে পায় বিশেষ করে ৬০০ হার্যের নিচের শব্দ। কিন্ত আমরা এথেকেও অনেক দীর্ঘ কম্পাঙ্কের শব্দ শুনতে পাই (১৫–১৮,০০০) হার্য । অর্থাৎ আমরা যা শুনতে পাই তার এক অস্পষ্ট ভার্সন সাপেরা শুনতে পায়। মানুষের কন্ঠের স্বাভাবিক কম্পাঙ্ক হল ১০০ থেকে ২৫০ হার্য। যা লিঙ্গভেদে ভিন্ন হতে পারে। আমাদের পরীক্ষার মধ্যে উল্লেখিত ফ্রিকোয়িন্সির রেঞ্জ ছিল। আমরা ১.২ মিটার দূরত্বে ৮৫ ডেসিবলে শব্দের সৃষ্টি করি। তাই বলাই যায় যে সাপ আমরা জোরে বা চিৎকার করে সাধারণত যে কথাগুলো বলি তা সাপ শুনতে পায়। এর মানে আপাতত এটাও বলা সম্ভব নয় যে সাপ আমাদের সাধারণ কথাবার্তা অর্থাৎ যা ৬০ ডেসিবেলে পাওয়া সম্ভব সে কথা শুনতে পায় না। আমরা আপাতত এতটুকু বলতে পারি যে আমরা এ পরীক্ষা এখন পর্যন্ত করতে পারি নি। i।
পূর্বে যারা সাপের শোনার ব্যাপারে খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে বেড়াতেন যে সাপ শুনতে পায় না এবং সাপের ব্যাপারে ভুল ধারণা সংশোধন করার নামে এই খবর ছড়িয়ে বেড়িয়েছেন যে সাপ শুনতে অক্ষম আশা করি তারা নতুন করে সাপের ব্যাপারে আবারো সংশোধন লিখবেন।
রিপোর্টের তথ্যসমূহ আলোচিত গবেষণাপত্রSound garden: How snakes respond to airborne and groundborne sounds এবং ‘The Conversation’এ ক্রিস্টিনা–র( Cristina N. Zdenek) লেখা Snakes can hear you scream, new research reveals থেকে নেওয়া হয়েছে।