হলুদ বোলতা , বন্ধু নাকি শত্রু

হলুদ বোলতা , বন্ধু নাকি শত্রু

Spread the love

আমাদের স্থানীয় ভাষায় একে আমরা বল্লাবলি। এই বোলতার রঙ হলুদ হওয়াতে ছোটবেলাতে এই পোকার প্রতি কেমন যেন এক আকর্ষন অনুভব করতাম প্রথম প্রথম। কিন্ত প্রথম যেবার এই বোলতা হুল ফুটালো তখন থেকে একে শত্রু ভাবা শুরু। গত বছরের কোরবানির ঈদের দিনেও তিনটে বোলতার বোলতা আমার শরীরে হুল ফুটায়। যদিও এ ব্যাপারে আমার এবং বোলতার উভয়েরই কোন দোষ ছিল না। পাশের বাড়ির পিচ্চিরা বোলতাদের ঢিল মেরে বিরক্ত করছিল আমিও ঐ সময়টাতে বোলতার পাশ দিয়ে যাই বোলতা স্বাভাবিকভাবেই আমাকে শত্রু হিসেবে গন্য করে নেয়। যারা মাছ শিকারী বা ছিপ দিয়ে মাছ ধরতে পছন্দ করে তাদের নিকট এই বোলতার সবচেয়ে উপকারী দিক এছে এর লার্ভা। লার্ভা হচ্ছে মাছের জন্য অব্যর্থ টোপ। কিন্ত আমার এই আলোচনাতে এ টাইপের উপকারের বয়ান করব না। ইকোলজির দিক দিয়ে এর আলোচন করাটাই মূল উদ্দেশ্য।

হলুদ বোলতাকে ইংরেজিতে ‘Yellow paper wasp’ হিসেবে ডাকা হয়। অন্যকোন বোলতা চেনার ব্যাপারে ভুল হতে পারে কিন্ত এ জিনিস চিনতে কারো ভুল হওয়ার কথা নয়। এর কটমটে গায়ের হলুদ রঙ সহজেই বুঝিয়ে দেয় এর কাছকাছি যাওয়া বিপদজনক। এছাড়া এর নির্দিষ্ট গড়নের বাসা দেখেও তাকে চেনা যে কারো পক্ষে সম্ভব। অসংখ্য ষড়ভুজের সমন্বয়ে ছোট ছোট সেলের মাধ্যমে ছাতার গড়নের বাসা। এই পোকা মূলত প্রিডেটরি বা শিকারি পোকা । অর্থাৎ অন্যান্য পোকাদের এরা শিকার করে জীবনধারণ করে। একটা আশ্চর্য ব্যাপার হল যত প্রকার বোলতা আছে এই বোলতাকেই আরবান বা শহুরে জীবনে সবচেয়ে বেশি অভ্যস্ত হিসেবে দেখা যায়। একেবারে জনসাধারণের বাসস্থানের মাঝখানে কেয়ারলেসলি এরা বাসা বানায়। অনেকটা ড্যাম কেয়ার। তবে এর এক অসাধারণ পজিটিভ সাইড আছে । আমাদের বাগানের জন্য ক্ষতিকর বিভিন্ন ক্যাটারপিলার, মথ , ওর্ম খেয়ে এরা জীবনধারণ করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ক্যাটারপিলার যারা বাগানের পাতা খেয়ে সাবাড় করে ফেলতে পারে সেই পোকাগুলো থেকে আমাদের ছাদ বা বাসার সামনের বাগান কে রক্ষা করার জন্য কেমিকেলের প্রয়োজন হয়ে পড়ে । অনেকক্ষেত্রেই এই বোলতা আমাদেরকে এদের খেয়ে সাবাড় করে। ক্যাটারপিলার যদিও একটা সময় প্রজাপতি রূপান্তরিত হয়। কিন্ত ক্যটারপিলার বনে বা যেখানে পুরো ইকোসিস্টেম কার্যকর সেখানে অসংখ্য শিকারী প্রাণী থাকাতে এবং অভিযোজনের প্রক্রিয়াতে গাছপালাও এর থেকে পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম। কিন্ত আমাদের বাসা বাড়ির ছোট বাগানগুলোতে সাধারণত ইকোসিস্টেমের বড় একটা অংশ সরাসরি মানুষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এখানে ক্যটারপিলারের অনিয়ন্ত্রিত আক্রমণ যেকোন বাগান কে কয়েক রাতের মধ্যে ক্ষতি করে ফেলতে পারে। আমাদের বাসা বাড়ির ছোট বাগানগুলোর জন্য এই বোলতার ভূমিকা অনস্বীকার্য। তা আপনি কামড় খান বা নাই খান।

এর লাইফ সাইকেলও বেশ অদ্ভুত। এরা এদের ঘর বানায় সাধারণত কাঠ বা গাছ হতে নরম ফাইবার সংগ্রহ করে । ফাইবারের সাথে তাদের লালার মিশ্রণ ঘটিয়ে এক শেপ তৈরি করে ধীরেধীরে। আর হা ! তাদের এই বাসা কিন্ত পানিরোধী ! এদের পুরো লাইফ সাইকেল শুরু হয় এক একাকি ঘুরে বেড়ানো মহিলা বোলতা থেকে। সেই মূলত এদের প্রতিষ্ঠাতা। প্রথমে মহিলা বোলতা এক আদর্শ জায়গা নির্বাচন করে ঘর বানানোর জন্য। সে প্রথমে ঘর বানানো শুরু করে। এক এক সেল করে আস্তে আস্তে বাড়াতে থাকে। অনেক সময় অন্যান্য নারী বোলতাও এসে একটা দল গঠন করে একসাথে ঘর বানাতে থাকে। কিন্ত তাদের সংখ্যা হয় খুব কম। যখন ঘর বানানোর প্রাথমিক পর্যায় শেষ হবে তখন প্রতিষ্ঠাতা নারী বা এই বোলতাদের রানী ডিম দেওয়া শুরু করবে। যা কিছুদিন পর নারী লার্ভা হয়ে বের হবে। রানী বোলতাই শুধুমাত্র ডিম দিতে পারে। আর কেউ নয়। এবং সে তার বাচ্চারা পুরুষ হবে নাকি মেয়ে হবে সেটাও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যখন লার্ভা বের হয় তখন রানী বোলতার অনেক দায়িত্ব বেড়ে যায় সে ক্যাটারপিলার সহ অন্যান্য পোকাদের ধরে এনে লার্ভাদের খাওয়াতে থাকে। যখন লার্ভাগুলো বড় হয়ে নিজেরাও বোলতা হিসেবে বের হয় তখন তারা কর্মী বোলতা হিসেবে কাজ করা শুরু করে। যদিও গ্রীষ্মের শুরুর দিকে রানী বোলতা অন্যান্য নারী বোলতাদের তাড়িয়ে দেয় যাতে করে তারা অন্যকোন বোলতার বাসা দখল করতে পারে বা নিজেরাও নিজেদের ঘর বানানো শুরু করতে পারে। এই প্রথম ফেইজের সব নারী বোলতারাই সাধারণত অনুর্বর হয়।

এরপরে আবার রানী বোলতা ডিম দিতে শুরু করে। এই পর্যায় থেকে উর্বর বা ভবিষ্যৎ রানী বোলতা বের হবে। সাধারণত রানী বোলতা তার শরীরে চর্বি জমাতে আরম্ভ করে যা কর্মী বোলতা করতে পারে না। যখন ভবিষ্যৎ রানী বোলতার লার্ভা বের হবে তখন আবার প্রথম রানী বোলতা পুরুষ লার্ভার জন্য ডিম দিতে আরম্ভ করবে। মেইল লার্ভাদের মূল কাজ হল মিলন করা। এ টাইপের পোকারা মূলত নারী আধিপত্যে চলে। পুরুষ বোলতার সাথে মিলনের কার্যক্রম শুরু হয় শীতের আগে আগে। পরে এই প্রেগন্যান্ট বোলতাগুলো একত্রিত হয়ে কোন নিরাপদ স্থানে পুরো শীতের সিজনের জন্য নিজেদের কে শীতনিদ্রায় নিয়ে যায়। অর্থাৎ তারা তাদের মূল বাসা ত্যাগ করে। এসময় তারা সাধারণত পাইপ বাসা বাড়ির স্টোর রুম যেখানে মানুষের চলাচল কম এসমস্ত জায়গাতে আশ্রয় গ্রহণ করে। অনেক সময় বড় কোন গাছের কোটরেও এদেরকে আশ্রয় নিতে দেখা যায়।

যদিও এই বোলতাকে আমরা তার বিষাক্ত হুল ফোটানোর জন্য ভয় পাই কিন্ত এরাও কিন্ত পরাগায়নে ভূমিকা রাখে। আমরা যারা মনে করি একমাত্র মৌমাছিই পরাগায়নে সহায়তা করে এই মনে করাটা ভুল। এই বোলতারা মূলত হুমকি বা আঘাত না পেলে কামড়ায় না। যদিও এমন কোন স্থানে এরা আবাস গড়ে যেখানে মানুষের চলাচল হয় না বললেই চলে তাহলে সেখানে তাদের বাসা বানাতে দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। আর যদি মানুষের চলাচল এবং মানুষের অবস্থান যেখানে সরব সেখানে এর অবস্থান কে ক্ষতিকর হিসেবে বিবেচনা করা উচিত।

বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে পেপার ওয়াস্প সম্পর্কিত নির্ভরযোগ্য তথ্য অবলম্বনে লেখা।

প্রচ্ছদ ছবি কার্টেসিঃ Saowabullah Haque

২ thoughts on “হলুদ বোলতা , বন্ধু নাকি শত্রু

  1. সাব্বির

    হলুদ বোলতা বন্ধু কিংবা শত্রু যাই হোক না কেন এরা কামড়ালে অনেক ব্যাথা হয়। যে কোন প্রানী মানূষকে আগেই আক্রমন করে না বরং মানূষ এদের ক্ষতির চেষ্টা করলে এরা নিজেদের রক্ষা করে থাকে।

  2. Shambhu

    এই হলুদ বোলতা মানুষের যদি কামরায়
    তা হলে কী হবে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.