নরওয়ের সরকারের নেকড়ে নিয়ে উদ্ভট সিদ্ধান্ত যা নেকড়েদের বিলুপ্তি ঘটাতে পারে
এই শতাব্দীতে এসেও কোন রাষ্ট্র তার নিজের কোন মহাবিপন্ন শ্রেণীভুক্ত প্রাণীকে শিকারের নামে হত্যা (Culling) করার অনুমতি দিতে পারে তা নরওয়ে নামক রাষ্ট্র না থাকলে জানতাম না। নরওয়ে গত ২০২০ এর জুন মাসে নেকড়ে হত্যা করার বৈধতা প্রদান করে [১]। WWF এর দেওয়া তথ্যমতে নরওয়ে তে নেকড়ের সংখ্যা হবে ৬৫–৬৭ এর মধ্যে। আর সুইডেন এবং নরওয়ের সীমানা ঘেষে যে নেকড়ে আছে তার সংখ্যা হবে ৪০–৪১ [২] । অর্থাৎ মাত্র এ কয়েকটা নেকড়ে নরওয়ের জন্য মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাড়িয়েছে ! ভাবতেও অবাক লাগে। নরওয়ে নেকড়ে হত্যা করার অনুমতি দিয়েছে শিকারীদের ব্যাপারটা অনেকটা এরকম বাংলাদেশী সরকার সুন্দরবনের বাঘ, টেকনাফের হাতি এগুলোকে হত্যা করার অনুমতি দান করেছে। অর্থাৎ কোন রাষ্ট্র যদি তার মহাবিপন্ন শ্রেণীভুক্ত প্রাণীকে হত্যা করার অনুমতি দান করে তাহলে তাতে শকড না হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। কোন মহাবিপন্ন শ্রেণীভুক্ত প্রাণীকে কালিং বা হত্যা করার অনুমতি দেওয়ার অর্থ হল তার বিলুপ্তি ঘটানো।
গত বছরের শেষের দিকে গার্ডিয়ান তাদের ইউটিউব চ্যানেলে এ সংক্রান্ত ত্রিশ মিনিটের এক ডকুমেন্টারি প্রচার করে। তার টাইটেল ছিল The Wolf Dividing Norway the hunter v the environmentalist [৩]. এই ডকুমেন্টারিতে দু পক্ষের যুক্তি তুলে ধরা হয়। শিকারীদের যুক্তি হল, নেকড়ে কৃষকদের ভেড়ার পালের ক্ষতি করে। নেকড়ে ভেড়ার কান ছিরে নেয় কারো বা পেট ছিন্নভিন্ন করে দেয় যা দেখতে খুবই ভয়ানক। নেকড়ে নরওয়ে তে মহাবিপন্ন প্রাণী হলেও নরওয়েতে এর কোন প্রয়োজন নেই। পৃথিবীতে নেকড়ের জন্য অনেক দেশ আছে। নেকড়ে হত্যা করতে না দেওয়ার মানে হল আমাদেরকে অবৈধ কাজ করার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ নেকড়ে হত্যা করার ঝুঁকি“।
অন্যদিকে পরিবেশবাদীদের বক্তব্য হল, নেকড়ে নরওয়ের প্রকৃতি অংশ। আমরা তা হত্যা করতে পারি না। এটা আমাদের বায়োডায়ভার্সাটির অংশ। আমাদেরকেই একে রক্ষা করতে হবে। আমাদের পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে এর সমাধান করতে হবে। কি ভাবে নেকড়ে থেকে ক্ষতির পরিমাণ কমানো যায় সেই চেষ্টা করতে হবে“।
কিন্ত কে শোনে কার কথা। নেকড়ের বিরুদ্ধে যাদের অবস্থান তাদের নেতৃত্ব দেয় একদল শিকারী ব্যক্তি যারা বংশগতভাবেই শিকারী। তারা এ নিয়ে পুরো নরওয়ে ব্যাপী মিটিং মিছিল করে। এদের মধ্যে কেউ কেউ পরিবেশবাদীদের হুমকি দেয়। আবার শিকারীদের দাবি হচ্ছে আমাদেরকেও পরিবেশবাদীরা মৃত্যুর হুমকি দেয় এবং ভয় দেখায়। যাইহোক, এই বিষয়টা অনেকদিন পার্লামেন্টে ঝুলছিল। কিন্ত নেকড়ের বিরুদ্ধে যারা আন্দোলন করছে তাদের আগ্রাসী মনোভাব এবং সরকারের ভুল সিদ্ধান্তে শেষ পর্যন্ত হতাশই হতে হয়। তাদের বক্তব্য হল সরকার যদি নেকড়ে হত্যা করার অনুমতি প্রদান নাও করে তারপরেও যেহেতু ডেমোক্রেটিক দেশ তাই বেশি মানুষ যেহেতু নেকড়ে হত্যার পক্ষে তাই আমরা নেকড়ে হত্যা করব। পরিবেশবাদীরা তাকিয়ে ছিল পলিসিমেকারদের দিকে। শিকারীদের বক্তব্য হল, পলিসি মেকাররা থাকে শহরে তারা নেকড়ের সাথে বসবাস করার ভয়াবহতা বুঝবে না। যাইহোক, শেষ পর্যন্ত শিকারী দলের সিদ্ধান্তই স্বার্থকতার মুখ দেখে। তারা এ নিয়ে বিজয় উল্লাস করে। আকাশে আতশবাতি ফুটিয়ে তা উদযাপন করে। নরওয়ের এরকম সিদ্ধান্ত একেবারে শকড হওয়ার মত এবং বাস্তবতা বিবর্জিত এক সিদ্ধান্ত।
নেকড়ের সাথে নরওয়ের মানুষ এবং সরকারের এরকম আচরণ নতুন কিছু নয়। এর আগে নেকড়ে হত্যা করতে করতে করতে একেবারে শূন্যের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার পরে ১৯৭১ সালে নরওয়ের সরকার একে প্রোটেক্টেড প্রজাতি হিসেবে ঘোষণা দান করে। কিন্ত গত বছরের জুনে ওসলোর পার্লামেন্টে যে রেজুলেশন জারি করা হয় সেখানে বলা হয় জনগনের নিরাপত্তার এবং জনগনের স্বার্থে বন্য প্রাণী হত্যা করা যাবে। আরো বলা হয় একটা নির্দিষ্ট সংখ্যা ধরে দেওয়া হবে যা অতিক্রম করলেই হত্যা করে তা আবার নির্দিষ্ট সংখ্যা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হবে। নতুন ধরে দেওয়া নেকড়ের সংখ্যা হবে প্রতি বছর চার থেকে ছয়টি বাচ্চা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকবে । আরো কিছু অ্যাক্টে বলা হয় নেকড়ে তার সংরক্ষিত এলাকার বাহিরে নেকড়ে চলে গেলে তা হত্যা করার অনুমতি রয়েছে।
এখানে প্রশ্ন হল, নরওয়ের সরকার যে পরিমাণ নেকড়ে রাখার অনুমতি দিয়েছে অর্থাৎ নির্দিষ্ট হারে নেকড়ে হত্যা হলে নেকড়ে কখনোই মহাবিপন্ন শ্রেণী থেকে বের হয়ে আসতে পারবে না। বরং তার উল্টোটা ঘটবে। এছাড়া নেকড়ে দ্বারা যেভাবে মানুষের ক্ষতির বিষয়টি আলোকপাত করা হচ্ছে তা অনেকটাই বাড়াবাড়িতুল্য। গত দুশ বছর নেকড়ে দ্বারা কোন মানুষের আক্রান্ত হওয়ার রেকর্ড নেই। নেকড়েকে বিভিন্ন হলিউডের ছবিতে যেভাবে তুলে ধরা হয় নেকড়ে বরং তার উল্টোই। নেকড়ে মানুষ্কে এড়িয়ে চলতে পছন্দ করে। মানুষ যে পথে চলাচল করে নেকড়ে সে পথ এড়িয়ে চলে। নেকড়ে দ্বারা কৃষকদের ভেড়ার পালের আক্রান্ত হওয়াকে যেভাবে বলা হয় তাও পরিমাণে খুব কম। এছাড়া অন্যান্য অনেক কারণে ভেড়াদের মারা যাওয়ার সংখ্যা বেশি। রোগ, বিষাক্ত শস্যদানা খাওয়া, দুর্ঘটনা ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে ভেড়া বেশি মারা যায়। শতকরা আশি পার্সেন্ট মৃত্যু এসমস্ত কারণেই ঘটে। অপরদিকে মাত্র দুই পার্সেন্ট ভেড়ার মৃত্যু হয় নেকড়ের কারণে। নরওয়ের নেকড়ের প্রধান ডায়েট হল মুস (Moose) । ডায়েটের নব্বই পার্সেন্ট মুসই। আর বাদবাকি অন্যান্য প্রাণী তো রয়েছেই। বরং নরওয়ে সরকারের রেজুলেশনের অনেক কিছুই শিকারীরা মানছে না। তারা নির্দিষ্ট সংখ্যার বেশি নেকড়ে হত্যা করছে। পুরো নেকড়ের একটি দলকে হত্যা করে ফেলছে। এমনকি নেকড়েদের জন্য ঘোষিত নির্দিষ্ট সংরক্ষিত এলাকাতে গিয়েও নেকড়ে হত্যা করা হচ্ছে। আর সুইডেন এবং নরওয়ের নেকড়েদের মধ্যে পারস্পরিক প্রজননের কারণে তাদের জীবন আরো হুমকির সম্মখীন। কেননা, ডি এন এ বাছাই করে নিলে দেখা যাবে সব ঐ এলাকার সব নেকড়েই একজন আরেকজনের কাজিন। অর্থাৎ সবাই একই বংশের। ডি এন এ ভ্যারাইটিজ নাই বললেই চলে। এক্ষেত্রে যা হয় তাহল কোন এক নেকড়ে যদি কোন ছোয়াচে রোগ বা প্যারাসাইট দ্বারা আক্রান্ত হয় তাহলে ধারণা করা যায় যে অতি সহজে অন্যান্য নেকড়েরাও ক্রমান্বয়ে আক্রান্ত হয়ে পড়বে । অর্থাৎ যেকোন সাধারণ রোগেও পুরো নেকড়ে দল অস্তিত্বহীন হয়ে যেতে পারে।
নরওয়ের এরকম সিদ্ধান্ত থেকে সড়ে আসা উচিত। নরওয়ের এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিকভাবে চুক্তিবদ্ধ। Bern Convention on Biological diversity (CBD) এর কনভেনশন অনুসারে বিপন্ন শ্রেণীভুক্ত প্রাণীকে রক্ষা করার জন্য নরওয়ে দায়বদ্ধ। সারা পৃথিবীর বায়োডায়ভার্সাটি যেখানে হুমকির সম্মখীন এবং আমরা যখন পৃথিবীর ষষ্ঠ বড় বিলুপ্তির স্বাক্ষী হতে যাচ্ছি সেখানে নরওয়ের এরকম সিদ্ধান্ত দুর্ঘটনা কে আরো এগিয়ে নিয়ে আসবে। এছাড়াও অন্যান্য রাষ্ট্র নরওয়ে কে দেখে নেকড়ে এবং অন্যান্য অ্যাপেক্স প্রিডেটর পর্যায়ের প্রাণীদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত বদলিয়ে ফেলতে পারে। কেননা পুরো পৃথিবীজুড়ে প্রাণী আবাসস্থল ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হওয়ার কারণে মানুষ এবং বন্য প্রাণীর মধ্যকার সংঘর্ষ বেড়েই চলছে। কিন্ত ব্যাপকহারে হত্যা করা অথবা মানুষের জীবন এবং চাহিদাকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করা কোনটাই উচিত কাজ হবে না। এর সমাধান মানুষেরই বের করতে হবে।
তথ্যের সোর্সঃ
[১] https://sciencenorway.no/animals-society-and-culture-wolves/political-controversy-over-how-norway-decides-to-shoot-wolves/1702886
[২] https://www.wwf.no/dyr-og-natur/truede-arter/rovdyr-i-norge/save-our-wolves
[৩] https://www.youtube.com/watch?v=EesdPOSXFTE