আমাদের জীবিত ড্রাগন ‘বড় গুই’ (Asian Water Monitor Lizard)
সেদিন দুপুরে ছাঁদে রৌদ পোহানোর জন্য গিয়ে দেখি বাসার এরিয়ার একেবারে কোণাতে খালের অপর পাশে বাঁশ গাছের ঝোপ আর অন্যান্য গুল্ম লতার ঝোপ মিলে মাটি থেকে সাত মিটার উপরে যে সবুজ তাঁবু বা ছাউনি গড়ে উঠেছে তার ঠিক উপরে শুয়ে আছে এক বিশাল গুই সাপ । প্রচ্ছদে সে জিনিসের ছবি সংযুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। ফেইসবুকের বিভিন্ন ওয়াইল্ড লাইফ গ্রুপ সমূহতে বা পেইজে যতজন যতবার এই বড় গুইয়ের ছবি দিয়েছে ততবার কিছু মানুষকে কমোডো ড্রাগন লিখে কমেন্ট করতে দেখেছি। এটা কি কোন ধরণের হেয়ালিপনা নাকি ইচ্ছাকৃত তা আমার জানা নেই। কিন্ত আপনাদের এক তথ্য দেই। আমাদের বাড়ির আশেপাশে ঘোরাঘুরি করা এই গিরগিটিই কিন্ত পৃথিবীর টিকে থাকা দ্বিতীয় বড় গিরগিটি। অর্থাৎ ইন্দোনেশিয়ার কমোডো ড্রাগনের পরেই এর অবস্থান। কমোডো ড্রাগনের সাথে একে মিলিয়ে ফেলা একেবারেই যে বেখেয়ালি এমনটা নয়। বাংলাদেশে প্রধানত তিন প্রকারের গুইসাপ থাকলেও সবথেকে বড় এই রামগদি গুই সাপই। একে অনেকে বড় গুইসাপও বলে থাকে। এর ইংরেজি নাম Water Monitor Lizard. বৈজ্ঞানিক নাম Varanus salvator. এই গুইসাপ কে অন্যান্য গুইসাপ থেকে আলাদা করা যায় তার শরীরের চামড়ার উপরে সারিবদ্ধভাবে থাকা ফুলের মত কিছু হলুদ রঙ এর নকশার দ্বারা। যা অনেকটা রিং এর মত দেখতে। এজন্য এদেরকে ‘Ring Lizard’-ও বলা হয় । যদিও একই ধরণের নকশা ‘Nile Monitor’ (Varanus niloticus ) বা নীল নদীর গুইতেও পাওয়া যায়। কিন্ত এশিয়াতে অন্যান্য গুই থেকে আলাদা করার ক্ষেত্রে এটা প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্যে একটি।
ছোটবেলা থেকেই এই গুইসাপদের আমাদের বাড়ির আশপাশে বিচরণ করতে দেখে আসছি। আমরা আজ যারা নিজ মফস্বল শহর ছেড়ে বড় কোন শহরে আছি তাদের সবারই স্মৃতির কোন না কোন অংশে গুই সাপ কেন্দ্রিক কিছু স্মৃতির অবস্থান আছে। আমাদের এলাকাতে এর অবস্থান কখনোই স্বাগত ছিল না। সত্যিকারার্থে বাংলাদেশের কোথাও গুই সাপ কে স্বাগত বা এর অবস্থান কে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়া হয় না। কিন্ত তারপরেও এরা টিকে আছে আপন মহিমায়। অপ্রতিরোধ্য সারভাইভার বললে ভুল হবে না। গুই সাপ গিরগিটি হওয়ার পরেও এর নামের সাথে বাংলা ভাষাতে কি করে সাপ শব্দটি যোগ হল তা আমাকে এক সময় ভাবাতো। কিন্ত এর মাঝখান দিয়ে চেরা জিহ্বাই এর প্রশ্নের উত্তরের জন্য যথেষ্ট। সাপেরও একই রকম জিহ্বা। এই জিহ্বা মূলত আশপাশের বস্তর ধরণ এবং অবস্থান বোঝার জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এছাড়া এর সাতারের ধরণ দেখেও যে কারো মাথায় প্রথমে সাপের চিন্তাই আসবে। সাপের সাথে এর আচরণগত প্রথম যে পার্থক্য সামনে আসবে তাহল এ প্রাণী যত কর্মকান্ড করে তা সব দিনের বেলাতেই। রাতের বেলা এর চালচলন খুবই বিরল [১] ।
এক শক্তিশালী সাতারু এই জীবের শারীরিক গঠনই বলে দেয় এ পানিতে থাকার জন্যই যেন তৈরি। পৃথিবীর সবথেকে বড় রামগদি গুইয়ের রেকর্ড আছে শ্রীলঙ্কার ক্যান্ডি লেকে। সেখানকার এক গুইয়ের সাইজ মাপা হয় ৩.২১ মিটার। যদিও তিন মিটার পর্যন্ত পৌছায় এরকম গুই খুব কমই পাওয়া যায়। ভারতে ২.৫ মিটারের বেশি পাওয়া যায় না। যদিও একটি প্রাণীর দৈত্যাকার হওয়ার জন্য ২.৫ মিটারই যথেষ্ট [২]।মনিরুল এইচ খান স্যারের বইতে এর লেজের দৈর্ঘ্য দেওয়া আছে ১.১৪ মিটার [৩]। এত বড় লেজকে এরা সাতারের পাশাপাশি ভীত সন্ত্রস্ত হলে চাবুক হিসেবেও ব্যবহার করে। এই গুইদের বৈশ্বিকভাবে দেখা পাওয়া যায় মূলত এশিয়াতেই। এশিয়ার অনেক রাষ্ট্রেই এরা আছে। ভারতের আন্দামান নিকোবরের মত অনেক প্রত্যন্ত দ্বীপেও এদের অবস্থান রয়েছে। এদের অত্যন্ত চমকপ্রদ সাতার কাটার ক্ষমতা এদেরকে ঠাই দিয়েছে প্রত্যন্ত থেকে প্রত্যন্ত দ্বীপে।
রামগদি গুই সাপের জীবন শুরু হয় ডিম থেকে। প্রাপ্তবয়স্ক মা গুই গাছের কোটরে বা জলাধারের পাশের গর্তে ডিম দেয়। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে সময় নেয় পাঁচ থেকে নয় মাসের মত। অর্থাৎ এটা যেনতেন ব্যাপার নয়। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়ে সফলতার মুখ দেখা অনেকটাই ভাগ্যের উপর নির্ভর করে। অনেক সময় টারমাইট তারপর ফাঙ্গাস এই ডিম নষ্ট করে ফেলে। অনেক সময় ডিম পানির নিচে চলে যায়। যে কোন কিছু হতে পারে। বাংলাদেশে মে থেকে অক্টোবর মাসের মধ্যে এদেরকে ডিম দিতে দেখা যায়। ডিম থেকে বাচ্চা বের হওয়ার পর তারা প্রথম অবস্থান নেয় গাছের ডালে। প্রথম বছর তারা বেশিরভাগ সময় গাছের ডালে ডালেই থাকে। আমার নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি এরা ঘন্টার পর ঘন্টা কোন রকম কান্ডবিহীন গাছ যেমনঃ খেজুর বা নারিকেল গাছে কাটিয়ে দিতে পারে। শুধুমাত্র খাবারের প্রয়োজন হলেই এরা নিচে নামে। এদের খাদ্যের লিস্ট অনেক বড়। পোকা মাকড়, মাছ, শামুক, ছোট ইঁদুর প্রজাতির প্রাণী, কাঁকড়া অথবা যে কোন ছোট প্রাণী যা তাদের পক্ষে গলাধঃকরণ করা সম্ভব তার কিছুই বাদ যায় না। বড় হওয়ার সাথে সাথে এরা বড় জিনিস কে টার্গেট বানাতে শুরু করে। পাখি, মানুষের হাঁস,মুরগি কিছুই বাদ যায় না। এদের খাদ্য তালিকা বিশাল। এদের খাদ্য তালিকায় আছে গলিত মাংস, পোকা মাকড় থেকে শুরু করে বড় সাইজের স্তন্যপায়ী প্রাণী। প্রাণীদের তালিকায় আছে পাখি, ইঁদুর জাতীয় প্রাণী, ছোট সাইজের হরিণ, বানর, মানুষের পালন করা ছাগল, ময়লা আবর্জনা, মানুষের মল , এমনকি মৃতদেহ। মানুষের মৃতদেহ খাওয়ার ব্যাপারে এদের বেশ দুর্নাম রয়েছে। একটা সময় সেন্ট মার্টিন এর দ্বীপবাসিরা মানুষ মারা যাওয়ার পরে মৃতদেহ কে রামগদি গুই থেকে রক্ষা করার জন্য অনেক কষ্ট করতে হত। কেননা এরা কবর খুড়ে মৃতদেহ খেয়ে ফেলত। এছাড়াও এদের খাদ্য তালিকায় পাখির বাসাতে ঢুকে ডিম সাবাড় করে দেওয়া নিয়মিত ব্যাপার [৪]। এ জিনিস দেখার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। Competitive Relationships between Monitor Lizards and Birds in Bangladesh শিরোনামে এক রিসার্চ পেপারে সুন্দরবনে রামগদি গুই এবং পাখিদের মধ্যকার প্রতিযোগিতা এভাবে তুলে ধরা হয়, ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের বাস্তুসংস্থানে সুন্দরবনের রামগদি গুই বা ওয়াটার মনিটর লিজার্ড তাদের আবাসস্থল এবং রোদ পোহানোর জন্য গাছ ব্যবহার করে। কিছু পাখিও গাছের ভিতরকার গর্তকে নিজেদের বাসা এবং আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহার করে থাকে৷ এজন্য প্রায় সময়েই পাখি এবং গুইয়ের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এই অবস্থাতে গুই বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করে তাদের আশ্রয়স্থল কে রক্ষা করে। যখন কোন আক্রমণাত্মক পাখি গুইয়ের নিকটে চলে আসে তখন গুই তার সামনের অংশ যতটুকু সম্ভব ততটুকু পরিমাণ স্ফীত করে তুলে। এতে তাদেরকে আরো বড় মনে হয় এবং পাখিদের আতঙ্কিত করতে সহজ হয়। তারা তাদের সব পায়ের উপর দাড়িয়ে, ফুসফুস কে বড় করে তোলে, পিছনের দিককে সমান করে এবং হিস করে শব্দ তুলে, অনেক সময় তারা দুলতে থাকে। শেষ কাজ হিসেবে তারা মুখ খুলে হা করতে থাকে [৫]। সেন্ট মার্টিন আইল্যান্ডে গ্রীন টার্টেল (Chelonia mydas ) এর আবাসে এদেরকে প্রায়ই আক্রমণ করতে দেখা যায় [৬]। এরা সুযোগ এবং খাবারের অভাবে থাকলে অন্যান্য গুইসাপকেও খেয়ে ফেলে। বিশেষ করে বাচ্চা গুই। আশ্চর্য ব্যাপার হল এদের কাছে বিষাক্ত সাপও ধরাশায়ী। বিষাক্ত সাপও এদের খাদ্য তালিকায় রয়েছে। রাসেল ভাইপারের মত বিষাক্ত সাপও এদের নিকট উপাদেয় খাদ্য [৭]। Activity budgets and dietry investigations of Varanus Salvator in Karamjal ecotourism spot of Bangladesh Sundarbans mangrove forest নামক রিসার্চ পেপারে তাদের একটা খাদ্য তালিকা তুলে ধরা হয়। সেখানে উল্লেখ করা হয় তাদের ডায়েটের বড় একটা অংশ জুড়ে রয়েছে কাঁকড়া। সাদু পানি এবং নোনা পানি উভয়ের ডায়েটেই রয়েছে এ খাবার। এছাড়াও পিপড়ে, ঝিঝি পোকা, প্রজাপতি, সেন্টিপিড, মাকড়সা, ছোট মাছ, ব্যাং, শামুক, সাপ, সাপের ডিম, ঘরের টিকটিকি, গিরগিটি, কুমিরের ডিম প্রভৃতি খাওয়ার রেকর্ড উল্লেখ করা হয় [৮ ]।এরা আমাদের শহর এবং পল্লী এলাকাতে খাদ্য শৃঙ্খলার সবথেকে উচুতে থাকলেও বনে ব্যাপারটা ভিন্ন। সুন্দরবনের কথাই ধরা যাক, সুন্দরবনে এদেরকে যারা খাদ্য তালিকায় নিয়েছে তারা হল লোনা পানির কুমির , বেঙ্গল টাইগার, অজগর সাপ, কিং কোবরা এরা সবাই বড় থেকে বড় গুই সাপ কে ধরাশায়ী করতে সক্ষম। এছাড়াও সুন্দরবনের বাহিরে লেওপার্ড বা চিতাও এদের ধরাশায়ী করতে সক্ষম। কিন্ত এই গুই সাপও সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। তার শক্তিশালী লেজে দিয়ে পালটা আঘাত তার রক্ষা কবচ হয়ে দাড়ায়। এছাড়াও এদের শক্তিশালী , ধারালো নখর দ্বারা তারা বেশ কিছুক্ষণ শিকারী প্রাণীদের আটকিয়ে রাখতে পারে। এছাড়াও দাতের ধারালো খাজ কাটা অংশের দ্বারা মাংস ছিন্ন ভিন্ন করতে সক্ষম। আর এর পেশীযুক্ত মাংসল দেহ যে কারো মধ্যে ভীতি ধরিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। এছাড়াও এর দেহের অস্থিময় চামড়া এর পৃষ্ঠ কে ঢেকে রাখে যা অনেকটা বর্মের কাজ দান করে। এই চামড়ার বর্ম মূলত হাড়ের সংযুক্তি সমৃদ্ধ চামড়া দিয়ে তৈরি একে ‘ Osteoderm’ বলা হয়। সবচেয়ে বড় কথা হল এই লিজেন্ডারি প্রিডেটরের উপর তার আশপাশে থাকা সকল সাপের বিষ অকার্যকর। এটা তার হাজার বছর ধরে থাকা অভিযোজনের ফসল। বেশিরভাগ সাপের কামড় তার চামড়া ভেদ করে ভিতরে প্রবেশ করতে পারে না। কিন্ত যখন কোন বড় গুই অন্য গুইয়ের সাথে লড়াই করে তখন প্রতিপক্ষের চামড়া ধারালো নখড় ধারা ছিড়ে ফেলে। নিঃসন্দেহে এরকম দুই দৈত্যের লড়াই দেখতে পারা অতুলনীয় কোন দৃশ্য হয়ে দাড়াবে। এই লড়াই তারা সাধারণত কোন মেয়ে সঙ্গীর সাথে সম্পর্ক করার জন্য প্রতিযোগিতা হিসেবে করে থাকে। যে লড়াইতে জিতবে সেই নির্দিষ্ট কোন মেয়ে সঙ্গীর মধ্যে তার বংশের বীজ দান করতে পারবে।
প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে গুইরা সাধারণত পুরুষদের থেকে ছোট হয়। পুরুষের সাথে তাদের মিলন সাধারণত পানির নিচেই হয়ে থাকে এবং তা ঋতুভিত্তিক। আমাদের এ অঞ্চলে তা সাধারণত বর্ষার ঋতুতে হয়।কয়েক সপ্তাহ পরেই সে শুকনো ভূমিতে টারমাইটের কোন গর্ত খুঁজে নেয় আর নয়তো নিজেই গর্ত খুরে সেখানে পাঁচ থেকে বিশটি ডিম দান করে আসে। তারপর সে গর্ত মাটি দিয়ে বন্ধ করে দেয়। একজন মা হিসেবে মেয়ে গুই সাপের দায়িত্ব এতটুকুই মাত্র। এরপরে সে আবার খাদ্যের খোঁজে চলে যায় তার আগের স্থানে এবং নিজেকে পরবর্তী বছরের জন্য তৈরি করতে থাকে।
গুই সাপের আলোচনা আসলে যে আলোচনাটা সবথেকে বেশি আসে তাহল গুই সাপের কি বিষ আছে? অর্থাৎ গুইয়ের কামড়ে কোন বিষক্রিয়া হয় কিনা। আসলে এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত নির্দিষ্ট করে আমাদের দেশীয় বা স্থানীয় গুইসাপদের উপর বিস্তর গবেষণা হয় নি। কিন্ত একই ধরণের কিছু লিজার্ডের (Varanoidea) লালাতে ভেনমের উপস্থিত নতুন কিছু গবেষণাতে উঠে এসেছে। যাদের ব্যাপারে পূর্বে ভাবা হত যে তারা বিষহীন। ২০১৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার একদল গবেষক দল গিরগিটিদের লালা নিয়ে বিস্তর গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। সেখানে Varanoid প্রজাতির ষোলোটি গিরগিটি নিয়ে গবেষণা করা হয় এর পাশাপাশি আরো চারটি ভিন্ন প্রজাতির গিরগিটি নিয়েও বিস্তর গবেষণা করা হয়। এদের লালার কেমিক্যাল বিশ্লেষণ করে প্রায় প্রত্যেকটারই লালায় টক্সিক কেমিক্যাল এর উপস্থিতি পাওয়া যায়। এর বেশিরভাগ গিরগিটির ব্যাপারে ধারণা করা হত যে এদের স্যালাইভা বা লালাতে সর্বচ্চ পরিমাণ ব্যাক্টেরিয়া থাকতে পারে যা শিকার কে দুর্বল করে দেয়। কিন্ত এই গবেষণা নতুন মোড় নেয়। এমনকি এদের লালা আলাদাভাবে ইঁদুর জাতীয় প্রাণীদের শরীরে প্রবেশ করিয়ে অনেকটা একই রকম ফলাফল পাওয়া যায় ঠিক যেরকম সাপের বিষ প্রবেশ করালে পাওয়া যায়। যদিও এই গবেষণাকর্মে আমাদের দেশীয় গুইদের লালা নিয়ে কোন নির্দিষ্ট পরীক্ষণ হয়নি। গবেষণাপত্রে Varanus salvator এর ব্যাপারে উল্লেখ করা হয় যদি এর স্যালাইভা নিয়ে আলাদাভাবে গবেষণা করা হয় তাহলে আশা করা যায় এ ব্যাপারে আমরা আরো তথ্যপূর্ণ ফলাফল বের করতে পারব [৯]। এছাড়াও উপমহাদেশের আরেক বড় গুই বেঙ্গল মনিটর Bengal Monitor (Varanus bengalensis) এর ব্যাপারেও ধারণা করা হয় যে এরা বিষহীন। কিন্ত এদের কামড়ে ভিক্রান্ত এবং ভার্মা নামে দুজন লোক মারা গেলে আলাদাভাবে Renal Failure নামক জার্নালে Department of Nrphrology, Indira Gandhi Medical College এর তত্ত্বাবধানে আর্টিকেল পাবলিশ করা হয় যার শিরোনাম ছিল , Monitor lizard bite-induced acute kidney injury – a case report। এখানে বেঙ্গল মনিটরের কামড়ে দুজন লোক মারা যায় তা উপসর্গসহ আলোচনা করা হয় [১০]। এই আর্টিকেলের জবাবে আবার আরেকটা গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ প্রকাশ করা হয় যার শিরোনাম হল, Reply to Vikrant and Verma about “Monitor Lizard Envenoming” । এই গবেষণাধর্মী প্রবন্ধে সর্বশেষে উল্লেখ করা হয় এটা বলা সম্ভব নয় যে Varanid প্রজাতির কোন গিরগিটির দ্বারা বিষ ক্রিয়া হওয়া সম্ভব নয়। আমাদের উদ্দেশ্য হল কোন প্রাণীর কামড় কে লিথাল বা বিষাক্ত কামড় হিসেবে চিহ্নিত করতে হলে বিস্তর গবেষণাকর্ম করা উচিত বিশেষ করে যে প্রাণীর ব্যাপারে আগে কোন এরকম ঘটনা প্রকাশ পায়নি। এটাইপের কর্মে মেডিকেল, বায়োলজিক্যাল স্পষ্ট প্রমাণ থাকতে হবে যা ভিক্রান্ত এবং ভার্মার ক্ষেত্রে হয়নি [১১]। এছাড়াও ২০১৭ সালেএকইভাবে ভারতীয় মরুভূমির গুইসাপ (Varanus griseus) এর কামড়ে একজনের কিডনি ফেইল করে মারা যায়। এটা নিয়ে জার্নালে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এ রিপোর্টের শিরোনামই ছিল ‘Acute kidney injury following rhabdomyolysis and sepsis after non-poisonous desert monitor bite’ অর্থাৎ এটা একটা সাধারণ কেস স্টাডি হলেও এরকম কেস নতুন করে গবেষণার দ্বার উন্মুক্ত করে [১২]। যাই হোক, সিঙ্গাপুরের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে আমাদের আলোচিত গুইসাপ কে ভেনোমাস বা বিষাক্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়। সেখানে বলা হয়, নতুনভাবে বিশ্বাস করা হয় যে, এদের এরকম গ্রন্থি রয়েছে যা থেকে তারা বিষ বের করতে পারে। যা তারা ছোট জাতীয় স্তন্যপায়ী প্রাণীদের কাবু করার জন্য ব্যবহার করে থাকে (যার উপসর্গ হিসেবে প্রকাশ পায় তীব্র ব্যাথা, ব্লাড প্রেসারের নিম্নগামিতা, রক্ত জমাটবদ্ধ হয়ে যাওয়া)। কিন্ত মানুষের উপর এর প্রভাব অত গুরুতর নয় [ ১৩]। এছাড়া ব্রিটানিকার আর্টিকেলেও একে বিষাক্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয় তবে মানুষের জন্য তা প্রাণনাশক নয় সেটাও উল্লেখ করে দেওয়া হয় [১৪] । যাই হোক, ভারতীয় এবং বাংলাদেশী গবেষকদের মতে গুইসাপ বিষাক্ত নয়। রামগদি গুই বা বড় গুইসাপ নিয়ে বাংলাদেশের যে কজন প্রাণীবিজ্ঞানী বিস্তর গবেষণা করেছেন তাদের গবেষণা পত্রে একে নির্বিষ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এজন্য দেখতে পারেন K.M. Mijanur Rahman এর ‘ Ecological Adaption of Monitor Lizards In The Altered Habitats And Their Conservation In The Tropical Ecosystems Of Bangladesh’[১৫] এবং K.M. Mijanur Rahman এবং M Monirul H Khan এর সম্মিলিত গবেষণাকর্ম ‘Public Attitudes toward Monitor Lizards (Reptilia: Varanidae): A Conservation Challenge in the Human-dominated Ecosystems of Bangladesh’ –তেও বড় গুইকে নির্বিষ বলা হয় [১৬]। এছাড়াও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণীবিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষক Dr. Md. Kamrul Hasan এর মতেও বাংলাদেশের গুইসাপেরা নির্বিষ [ ১৭]। ভারতীয় সরীসৃপবিদেরাও একই মত লালন করেন। সরীসৃপবিদ জেরি মার্টিন এর মতে ভারত উপমহাদেশের গুইদের উপর এখন পর্যন্ত এ নিয়ে নির্দিষ্টভাবে কোন কাজ হয় নি। যদিও কিছু ঘটনা পাওয়া যায় যেখানে এই নির্বিষ গুইদের কামড়ে বিষ ক্রিয়ার উপসর্গ প্রকাশ পেয়েছে। কিন্ত সেগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। জেরি মার্টিন (Gerry Martin) এবং তার সরীসৃপ গবেষকদল একটা দুটো এরকম ঘটনার ব্যাপারে আশ্বস্ত নন [ ১৮]। সে যাই হোক কোন মনিটর লিজার্ডের কামড় খেতে হলে আপনাকে সেরকম পর্যায়ের বিরক্ত করতে হবে যা একমাত্র তাকে ধরতে গেলেই সম্ভব। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাতে পেয়েছি এরা সাইজে যত বড় দৈত্যাকারই হোক না কেন বাস্তবিকপক্ষে এরা মানুষের অবস্থান কে খুবই ভয় পায়। এবং লাজুকও বটে। সরীসৃপবিদ রমালাস হুইটেকার কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে সে রামগদি গুইয়ের লেজের আঘাত খাওয়ার অভিজ্ঞতা কখনো হয়েছিল কিনা। এর জবাবে রমালাস বলেন, “ আমার এই গুইয়ের সাথে অসংখ্যবার মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে এবং অনেকবার লেজের আঘাত খাওয়ারও অভিজ্ঞতা হয়েছে। তবে তোমাকে সতর্ক হতে হবে যেন তার লেজের আঘাত মুখে এসে না লাগে। আমি জোড় দিয়ে বলতে পারি মুখে লাগলে চোখ বেরিয়ে আসতে পারে যদি আপনার ভাগ্য সহায় না হয়ে থাকে” [১৯]। চিটাগাং ইউনিভার্সিটির প্রাণীবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর এম ফরিদ হাসান এর মতে, রামগদি গুই সহ অন্যান্য গুই বাংলাদেশ থেকে বেশ কিছু কারণে কমে যাচ্ছে এরমধ্যে অন্যতম হল , বায়োডায়ভার্সাটির কোন তোয়াক্কা না করে ব্যাপক উন্নয়ন কর্ম গুইসাপদের আবাসস্থল ধ্বংস হওয়ার মূল কারণ। যা পরিণামে গুইদের সংখ্যা কমিয়ে আনছে। এর পাশাপাশি পাহাড়ি জেলাগুলোতে স্থানীয়দের দ্বারা এদের মাংসের জন্য শিকার করা এবং এদের চামড়ার জন্য দেশব্যাপী শিকার করাও এদের সংখ্যা দিনদিন কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। এদের কে বিলুপ্তির সম্মুখীন হওয়া থেকে রক্ষা করতে হলে আমাদেরকে এদের আবাসস্থল সংরক্ষণের পদক্ষেপ নিতে হবে এবং মাংসের জন্য এদের শিকার করা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে” [২০]। ভারতীয় সরীসৃপবিদ জেরি মার্টিন (Gerry Martin) বলেন, নগরায়ন এবং চাষের ব্যাপক চাহিদার কারণে গুইদের আবাসস্থল হুমকির সম্মখীন হচ্ছে । বিশেষ করে Water monitor (রামগদি গুই) কে বিভিন্ন স্থানে এখনো মাংসের জন্য শিকার করা হয়। আন্দামান এবং নিকোবরে সবখানে এই গুইদের দেখা পাবার পাবার কথা ছিল কিন্ত সেখানেও এখন আর তাদের তেমন একটা দেখা যায় না। যদি দেখা পায় যায়ও তারা খুব দ্রুততার সাথে কেটে পড়ে। এটা নিঃসন্দেহে শিকারের কারণে একটা প্রাণীর মধ্যে যে ভয়ের সৃষ্টি হয় সেই উপসর্গ। শুধু মাত্র শিকার করা বাদ দিলেই আমরা আবারো পূর্বের মত এই গিরগিটিদের দেখা পাব বলে আশা করি। তারা মানুষের জন্য নিরাপদ এবং ইঁদুর ও বিষাক্ত জাতীয় প্রাণীদের জন্য এক কার্যকর শিকারী প্রাণী। এবং এরা আমাদের বাস্তুসংস্থানের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ [২১]। এছাড়াও বাংলাদেশে বিভিন্ন এলাকাতে কোন প্রকার কারণ ছাড়াই গুইসাপ মারা হয়। ২১ মার্চ ২০১৯ এর Barta24 এর এক খবরে লেখা হয় , “চট্টগ্রামের পুরাতন ফিশারিঘাটের কর্ণফুলী রাস্তায় গুইসাপকে মারার জন্য ১০ থেকে ১২ জন শিশুর একটি দল ইট ও পাথর ছুঁড়ে মারছে । রাস্তা ধরে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করছে বিলুপ্ত প্রজাতির সরীসৃপ প্রাণিটি। কিন্তু দেহের ওজন বৃদ্ধির কারণে দ্রুত পালাতে সক্ষম নয় এটি। শিশুদেরও থামানোর কেউ নেই। গুইসাপটি পর্যায়ক্রেমে দুর্বল হয়ে যাচ্ছিল। পরে একটি ঝুপড়ি দোকানে ঢুকে পড়ে। এ সময় ওই দোকানে উৎসুক জনতা ভিড় জমায়” [২২]। পুরাতন পত্রিকার খবরপত্র খুঁজে বেড়ালে এরকম অসংখ্য খবর পাওয়া যাবে। প্রাণীবিজ্ঞানী K.M. Mijanur Rahman এবং M Monirul H Khan এর সম্মিলিত গবেষণাপত্র Public Attitudes toward Monitor Lizards : A Conservation Challenge in the Human-dominated Ecosystems of Bangladesh এ গুই সাপ হত্যা করার বেশ কিছু কারণ উল্লেখ করা হয়। সেখানে উল্লেখ করা হয়–প্রতিশোধমূলক হত্যা, মজা পাওয়ার জন্য হত্যা, রাস্তার যানবাহনের জন্য মারা যাওয়া, মানুষের পালন করা কুকুরের আক্রমণে হত্যা এবং বিষক্রিয়ার মাধ্যমে হত্যা। এই সমস্ত কারণ সমূহ গুইদের জন্য মূল হুমকি। এছাড়াও এদেরকে বিষাক্ত মনে করার জন্যও অনেকে হত্যা করে। অনেক সময় মানুষের পালন করা মুরগি, হাস খাওয়ার জন্যও গুই হত্যা করা হয়। এছাড়াও জেলেরা প্রতিবছর নগন্য কারণে অসংখ্য গুই হত্যা করে [২৩]। সমকালের ২০১৭ এর এক খবরে আসে বাগেরহাটের চিতলমারী থানাতে নিয়মতান্ত্রিকভাবে রামগদি গুই মারা হচ্ছে। এর প্রধান কারণ হিসেবে স্থানীয়দের থেকে যা উল্লেখ করা হয় তাহল হাঁস– মুরগি খেয়ে ফেলা [২৪]। IUCN এর Red List Of Bangladesh: Reptiles and Amphibians এ উল্লেখ করা হয়, মানুষের দূষণ সংক্রান্ত (anthropogenic) কর্মকন্ড এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের কারণে এর আবাসভূমি দিনদিন ছোট হয়ে আসছে তাই একে সংকটাপন্ন ( Vulnerable) তালিকায় স্থান দেওয়া হল [২৫]। আমাদের এটা মনে রাখা দরকার বাংলাদেশে অন্যান্য গুই পুরো দেশজুড়ে থাকলেও একমাত্র রামগদি গুইয়ের আবাসস্থল খুবই সীমিত এলাকা জুড়ে। এই সংরক্ষিত প্রণীটি শুধুমাত্র চট্টগ্রাম , বরিশাল, খুলনা এবং ম্যানগ্রোভ ও উপকূলীয় অঞ্চলে এর দেখা মিলে। এছাড়াও উত্তর পূর্ব এবং দক্ষিন পূর্বাঞ্চলেও এর দেখা পাওয়া যায়। মানিকগঞ্জ , কেরানিগঞ্জেও এর দেখা মিলে। এর লোকাল ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কিত তথ্য আমার নিকট অতটা আপডেটেড মনে হল না। কেননা আমাদের মাদারীপুরে আমরা ছোটবেলা থেকে বিভিন্ন জায়গাতে গুইয়ের বিচরণ দেখে আসছি। কিন্ত কোন ডেটাবেইজে মাদারীপুর জায়গাটার নাম দেখলাম না। এছাড়াও কুমিল্লা, নারায়নগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ সহ অনেক জায়গাতেই এ প্রাণীর বিচরনের খবর দৈনিক পত্রিকা বা ওয়েব পোর্টাল সহ সামাজিক মাধ্যমে প্রায়ই আসে। প্রাণীবিজ্ঞানীদের নিকট আবেদন এর রিজিওনাল ডিস্ট্রিবিউশন ডেটাবেইস আপডেট করে একে সংরক্ষনের প্রকল্প হাতে নেওয়া উচিত।
এই বড় গুইয়ের ব্যাপারে দেখা আমাদের সবথেকে কমন দৃশ্যগুলোর মধ্যে একটি হল খাল বা কোন জলাধার পার হয়ে তার মাঝখান দিয়ে চেরা জিহ্বাটি বের করে কি যেন খুঁজতে থাকে। হয়তবা কোন সঙ্গী বা কোন খাবারের আশায়। এই প্রাণীটি টিকে থাকুক এই প্রত্যাশায় প্রবন্ধের ইতি টানছি।
প্রয়োজনীয় তথ্যের উৎসঃ
[১] The Water Monitor Lizard Varanus salvator: Behavior, Ecology, and Human Dimensions in Banten, Indonesia by Linda Therese Uyeda ; Page no: 14 ;
[২] https://round.glass/sustain/conservation/water-monitor-lizard/
[৩] Page no.: 380; Photographic Guide to the Wildlife Of Bangladesh by M. Monirul H. Khan
[৪] Red List Of Bangladesh: Reptiles and Amphibians; Page no 79.
[৬] http://www.seaturtle.org/mtn/archives/mtn96/mtn96p19.shtml
[৭] https://www.youtube.com/watch?v=9LKilqQYwSU
[৮]https://www.researchgate.net/publication/320901490_Activity_budgets_and_dietary_investigations_of_Varanus_salvator_Reptilia_Varanidae_in_Karamjal_ecotourism_spot_of_Bangladesh_Sundarbans_mangrove_forest
[৯] Enter the Dragon: The Dynamic and Multifunctional Evolution of Anguimorpha Lizard Venoms by Page no. 26
[১০] Renal Failure 2014 ; 36 (3) ; 444-446
[১১] Renal Failure 2015 ; 37 (4) ; 740-741
[১৪ ] https://www.britannica.com/list/7-of-the-worlds-most-dangerous-lizards-and-turtles
[১৬] https://www.researchgate.net/publication/318056766_Public_Attitudes_toward_Monitor_Lizards_Reptilia_Varanidae_A_Conservation_Challenge_in_the_Human-dominated_Ecosystems_of_Bangladesh
[১৭] https://www.thedailystar.net/city/our-monitors-1476154
[১৮ ] https://round.glass/sustain/species/bengal-monitor-lizard/
[১৯] https://ecologise.in/2018/01/30/romulus-whitaker-herpetologist-wonderland/
[২০] https://www.thedailystar.net/backpage/water-monitor-struggling-survive-1394128
[২১] https://india.mongabay.com/2020/06/the-indian-dragons-we-know-so-little-about/
[২৪] https://samakal.com/todays-print-edition/tp-lokaloy/article/1703274787
[২৫] Red List Of Bangladesh: Reptiles and Amphibians; Page no 79.
This is my first time pay a quick visit at here and i am really happy to read everthing at one place
I do not even understand how I ended up here, but I assumed this publish used to be great
You’re so awesome! I don’t believe I have read a single thing like that before. So great to find someone with some original thoughts on this topic. Really.. thank you for starting this up. This website is something that is needed on the internet, someone with a little originality!
very informative articles or reviews at this time.
This is really interesting, You’re a very skilled blogger. I’ve joined your feed and look forward to seeking more of your magnificent post. Also, I’ve shared your site in my social networks!
I’m often to blogging and i really appreciate your content. The article has actually peaks my interest. I’m going to bookmark your web site and maintain checking for brand spanking new information.