ডেভিড অ্যাটেনবরোর সিন্দুকের প্রাণীরা – দ্বিতীয় পর্ব

ডেভিড অ্যাটেনবরোর সিন্দুকের প্রাণীরা – দ্বিতীয় পর্ব

Spread the love

প্রকৃতিবিদ ডেভিড অ্যাটেনবরো কে জিজ্ঞেস করা হয় যদি তাকে দশটি প্রাণীকে রক্ষার জন্য বলা হয় বা দশটি প্রানীকে তার কোন কল্পিত সিন্দুকে জায়গা  করে দেওয়ার কথা বলা হয় তাহলে তিনি কোন দশটি প্রাণীকে আলাদা করবেন । একজন প্রকৃতিবিদের জন্য এ কাজটা অত সহজ নয়। বিশেষ করে এরকম ব্যক্তির জন্য যে তার জীবনের সিংহভাগই কাটিয়েছেন প্রকৃতির সাথে। অ্যাটেনবরো বলেন, 

  ‘এটা এক অসম্ভব কাজ। আমি ঐ প্রাণীদের বাছাই করতে পারি যারা সর্বদা খবরের  শিরোনাম হয়ে আসে । যেমনঃ জাদুকরী বাঘ, অসাধারণ মেরু ভাল্লুক, সুন্দর বরফের লেপার্ড বাঘ, অথবা বিশাল শরীরের পাহাড়ি গরিলা । এদের কাউকেই আমি হারাতে চাই না। কিন্ত এগুলোর বাহিরেও আরো অনেক অসাধারণ প্রাণী রয়ে গিয়েছে যাদের হয়তবা কোন আলাদা  খ্যাতি নেই , হয়তবা অনেকে এদের নামই শুনেনি। আমি এরকম দশটা প্রাণীকে বাছাই করব। যাদের জীবন আমাকে মুগ্ধ করে।’

তাহলে এক এক করে দেখে নেওয়া যাক অ্যাটেনবরো কোন কোন মুগ্ধ করা প্রাণীদের বাছাই করেছেন। দ্বিতীয় পর্বে আপনাদের কে স্বাগতম। প্রথম পর্বটি পড়ে নিন এখান হতে

 

চতুর্থ পছন্দঃ

অনেক প্রানী আছে যারা তাদের পরিবেশের সাথে পুরোপুরি নিজেদেরকে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। তাদের খাদ্যভ্যাস সহ  তাদের শারীরিক অনেক বৈশিষ্ঠ্যতেও তা পরিবর্তন এনেছে। যেমনঃ জিরাফের লম্বা গলা যা তারা ব্যবহার করে গাছের মগডাল থেকে পাতা খাওয়ার জন্য অথবা পান্ডা যাদের প্রধান খাবরই হল বাঁশ গাছের পাতা যা হজম করা অনেকটাই কষ্টসাধ্য। ঠিক এরকমই এক প্রাণী হল ওম (Olm) । ওম জিরাফ বা পান্ডার মত বড় কোন প্রাণী নয় কিন্ত তার টিকে থাকা এবং নিজেকে মানিয়ে নেওয়াটাও ঠিক তাদেরই মত । ওলম উভচর প্রাণীর কিছু বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। পৃথিবীতে একশ নব্বই মিলিয়ন বছর ধরে টিকে আছে। আরো আশ্চর্য ব্যাপার হল ওমদের আয়ুষ্কাল একশ বছরের মত। ওমকে একমাত্র পাওয়া যাবে মধ্য ইউরোপ এবং দক্ষিন পূর্বাঞ্চলীয় লাইমস্টোন এর গুহাগুলোতে।

এখানে ওমরা টিকে আছে মিলিয়ন মিলিয়ন বছর ধরে। এই গুহাগুলো মাটির নিচের বিশাল নদীর নেটওয়ার্কের সাথে সংযুক্ত। এবং প্রতিটি গুহাই বিশাল কেভ নেটওয়ার্কের অংশ। এই অদ্ভুত প্রাণীটি পুরোপুরি গুহার পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিয়েছে এবং এর কোন দৃষ্টি শক্তি নেই। কিন্ত এর ঘ্রাণ শক্তি অতি তীব্র যা অনেকটা ষষ্ট ইন্দ্রিয়ের মত কাজ দেয়। এটা ইলেকট্রিক ফিল্ডের অবস্থা টের পায় ঠিক যেভাবে হাঙ্গরেরা টের পায়।

এই হল ওমের বিভিন্ন অলৌকিক ক্ষমতার মধ্যে একটি। ওম কিভাবে তার শিকার কে ধরে তা এখনো অজানা। হয়তবা তাদের স্পর্শকাতর ত্বক পানিতে থাকা যেকোন নড়াচড়া অনুভব করতে পারে। ওমের আরেকটা অদ্ভুত টিকে থাকার উপায় হল যদি কোন খাবার না পাওয়া যায় তাহলে সে উপবাস মুড বা একরকম শীতনিদ্রা গ্রহণ করে। এই অবস্থায় ওমেরা কোন রকম খাবার ছাড়া দশ বছর টিকে থাকতে পারে। ওমেরা বিপন্ন প্রাণী। এদের কে আরো বিপন্ন করে তুলছে আমাদের প্লাস্টিকের ব্যবহার। আমাদের প্লাস্টিক তাদের গুহাতেও কোন না কোনভাবে পৌছে যাচ্ছে।

পঞ্চম পছন্দঃ

ডেভিড অ্যাটেনবরোর ভাষায়

“আমার সিন্দুকে অবশ্যই কোন পাখিকে রাখতে হবে। কিন্ত কোন পাখিকে আমি বাছাই করব ? আমি যখন বালক ছিলাম তখন আমি বুঝতে পারি পাখিরা কতটা হৃদয় জয় করা সুন্দর হতে পারে। আমি তখন উনিশ শতকের একটি সুন্দর পাখির বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টানোর সুযোগ পাই। যে লোক এই প্রসিদ্ধ পক্ষিবিজ্ঞানসম্বন্ধীয় বই লিখেছেন তার নাম হল জন গুল্ড (John Gould)। তিনি ব্যক্তিগতভাবে হামিং বার্ডের ব্যাপারে মুগ্ধ ছিলেন। এর মধ্যে অনেক হামিংবার্ডেরই নাম জর্জ গুল্ড প্রথম দিয়েছেন।”

ডেভিড আরো বলেন,

 “আমি যখন এই ছবিটি দেখি তখন আমার মনে হয় সে এই ছবিটি নিজ মন থেকে আঁকে। কেননা একটা পাখির পক্ষে কি করে সম্ভব হতে পারে যে তার উড়ার সময় তার মাথা নিচের দিকে থাকবে আর তার লেজের  পাশে দুটো পালক একে অপরকে ক্রস করবে। আরো আশ্চর্য ব্যাপার হল গুল্ড কখনো এই পাখিকে জীবিত অবস্থায় দেখেন নি। কিন্ত গুল্ডের আঁকা ছবি সত্য। কয়েক বছর আগে হামিংবার্ডের এই উড়ন্ত অবস্থায় ভিডিও ধারণ করা সম্ভব হয়”।

এই হামিংবার্ডের অবস্থান হল আন্দিজের একেবারে নিচে পেরুর এক প্রত্যন্ত এলাকায়। এই হামিংবার্ডের নাম হল মার্ভেলাস স্পাটুলেটেইল (Marvelous spatuletail hummingbird) ।

এই পাখির দুটি বড় অবশিষ্ট পালক আছে যা তার লেজ কে দুই দিক থেকে ক্রস করে। প্রথমে মনে হবে পাখির এই অবশিষ্ট পালক দুটোকে অপ্রয়োজনীয়। কিন্ত এর উদ্দেশ্য বুঝা যায় যখন কোন স্ত্রী হামিংবার্ড নিকটে আসে। স্ত্রী হামিংবার্ডের এরকম সৌন্দর্যমন্ডিত কোন পালক নেই ।

স্ত্রী হামিংবার্ড যখন পুরুষ হামিংবার্ডের নিকটে এসে বসে তখন পুরুষ হামিংবার্ড তার এই পালক দুটোর কলাকৌশল দেখিয়ে মন জয় করার প্রচেষ্টা চালায়। প্রথমে সে ডালে বসে তার ঐ পালকদুটো নাড়াতে থাকে। যখন দেখে যে স্ত্রী হামিংবার্ড তার পারফরমেন্স দেখতে রাজি আছে তখন সে বাতাসে ভেসে দুটো পাখনা ব্যবহার করে নাচ দেখাতে থাকে। এভাবেই চলতে থাকে বেশ কিছুক্ষণ। এটা হামিংবার্ডের মিলন সংস্কৃতির অংশ।  অ্যাটেনবরো এই সুন্দর হামিংবার্ডটিকেও জায়গা করে দিলে তার সিন্দুকে।

ষষ্ঠ পছন্দঃ

পৃথিবীতে পাঁচ হাজার প্রজাতির উপরে ব্যাঙ রয়েছে। এদের মধ্যে আছে অনেক বিরল এবং অসাধারণ কিছু ব্যাঙ। কিন্ত অ্যাটেনবরো এদের মধ্যে যাকে বাছাই করেছে সেই ব্যাঙের নাম হল ‘ডারউইন ফ্রগ (Darwin frog)’।ডারউইন ফ্রগ নানা রঙের হয়ে থাকে এবং তারা অতি সহজেই তার আশপাশের সাথে নিজেকে মিশিয়ে ফেলতে পারে। কিন্ত অ্যাটেনবরো ডারউইন ফ্রগ কে বাছাই করে নেন আরেকটি কারণে। চার্লস ডারউইন ১৮৩৪ সালে এই ব্যাঙ আবিষ্কার করেন চিলিতে যখন তিনি এইচ এম এস বিগলে করে পৃথিবী ভ্রমণে ছিলেন। তার পকেট নোটবুকে এই ব্যাঙ কে ছোট করে নোটবুকের এক পাশে  এঁকে রাখেন। এবং এই ব্যাঙটিও অনেক ছোট।

এই ব্যাঙের সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয় হল এর বাচ্চাদের জন্ম হয় পুরুষ ব্যাঙ হতে ! এবং তা বের হয় তার মুখ দিয়ে। অন্যান্য পুরুষ ব্যাঙের মত ডারউইন ফ্রগও তার কন্ঠ কে ব্যবহার করে মেয়ে ব্যাঙকে আকর্ষন করার জন্য। কিন্ত এই ব্যাঙ শুধুমাত্র মেয়ে ব্যাঙকেই আকর্ষন করে না সে তার বাচ্চাদের খেয়ালও রাখে।

মেয়ে ব্যাঙ যখন ডিম ছাড়ে তখন পুরুষ ব্যাঙ সেই ডিম কে তার মুখের ভিতর নিয়ে নেয়। ডিম গুলো থাকে পুরুষ ব্যাঙের কন্ঠনালীতে। এবং সেখানেই ধীরে ধীরে ডিমের পরিস্ফুটন ঘটতে থাকে। এবং সেখান থেকেই এক সময় বাচ্চা ব্যাঙ বেরিয়ে আসে। এই ঘটনাটি ঘটে খুব তাড়াতাড়ি। 

 

 

ডারউইন ফ্রগের মূল আবাস হল সাউদার্ন চিলিতে। অ্যাটেনবরোর সিন্দুকের অন্যান্য প্রাণীরা মানুষ দ্বারা আক্রান্ত হলেও এই ডারউইন ফ্রগ প্রকৃতি দ্বারাই আক্রান্ত হয়। জুন ২০১১ তে মাউন্ট পিয়াহু (Mount Puyehue) তে আগ্নেয়গিরি হতে অগ্নুৎপাত শুরু হলে শত শত স্কয়ার মাইল জুড়ে ধোয়া এবং ছাইতে আচ্ছন্ন হয়ে যায়। ছাইয়ের কারণে গাছপালা ঢেকে যায়।

এই গাছপালার উপর নির্ভর করেই মূলত ডারউইন ফ্রগ টিকে থাকে। আগ্নেয়গিরির এই ঘটনা ডারউইন ফ্রগকে একেবারে বিলুপ্তির কাছাকাছি নিয়ে যায়।বিজ্ঞানী ক্লডিয় সোটো আজাট (Claudio Soto-Azat) ভাগ্যক্রমে এই অদ্ভুত প্রাণীটিকে বাচানোর জন্য এগিয়ে আসেন। সে বিরল ব্যাঙের উপর গবেষণা করছিল। ক্লডিও তার প্রথম পরিদর্শনে চারটি ব্যাঙ উদ্ধার করে।

এই ব্যাঙ নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে ওস্তাদ তাই তাদেরকে উদ্ধার করা অত সহজ ব্যাপার নয়। যেহেতু বন তখন পর্যন্ত নর্মাল হয়নি এবং এর গাছপালা ছাইতে ঢেকে ছিল। তাই ক্লডিয়া কিছু ব্যাঙ কে সাথে করে নিয়ে যায় এবং আগ্নেয়গিরির হুমকি কমে গেলে তাকে আবার ফেরত দেওয়ার নীতি পলিসি গ্রহণ করে।

তথ্যসূত্রঃ BBC এর Natural World ডকুমেন্টারি অবলম্বনে।

 

চলবে………

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.