অস্ট্রেলিয়াতে সাপে কাটা রোগী এত কম কেন ?
অস্ট্রেলিয়াকে নিউরোটক্সিক বিষের দেশ বললে ভুল বলা হবে না। এদেশে রয়েছে অসংখ্য বিষধর প্রাণীর বসবাস। যা আপনাকে ছোয়া মাত্রই আপনি শেষ নিদ্রার জন্য ঢলে পড়তে পারেন। এখানে বিষাক্ত তারা মাছ আছে যার ছোয়া আপনাকে ঘুম পাইয়ে দিবে। আছে বক্স জেলি ফিশ যা মৃত্যুকে কাছে নিয়ে আসে আর আছে বিষাক্ত ব্লু রিং অক্টোপাস । এখানে আছে ইনভেসিভ স্পেসিস বিষাক্ত কেন টোড। এরকম অসংখ্য প্রাণী রয়েছে যা অস্ট্রেলিয়ার ব্যাপারে মানুষকে ভীত করে। তবে সব থেকে আশ্চর্য বিষয় হল অস্ট্রেলিয়ার সাপ। বিশ্বের সবচেয়ে বিষাক্ত পঁচিশ প্রকার সাপের মধ্যে বিশ প্রকার সাপের বসবাস এই অস্ট্রেলিয়াতেই। একমাত্র অস্ট্রেলিয়াতেই দেখা মিলবে সবথেকে বিষাক্ত সাপ ইনল্যান্ড তাইপানের। এই সাপের এক কামড়ে যে পরিমাণ বিষ নির্গত হয় তা একশত মানুষকে মারার জন্য যথেষ্ট [১]।
এছাড়াও অস্ট্রেলিয়ার আরেক বিষাক্ত সাপ হল ইস্টার্ন ব্রাউন স্নেক। টক্সিক ভেনোম লিস্টে এর অবস্থানও উপরের দিকে। এছাড়াও আরো রয়েছে টাইগার স্নেক , মালগা স্নেক, ডেথ অ্যাডার , লো ল্যান্ড কপার হেড প্রভৃতি। এই প্রত্যেকটি সাপের একটা কামড়ই যথেষ্ট মৃত্যুর জন্য। অস্ট্রেলিয়াতে এত বিষাক্ত সাপ থাকার পরেও সাপের কামড়ে অস্ট্রেলিয়াতে মানুষ মারা যাওয়ার সংখ্যা খুবই কম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া তথ্যমতে প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় চুয়ান্ন লাখের মত মানুষ সাপের কামড়ে আক্রান্ত হয় তারমধ্যে আঠার লাখ থেকে সাতাশ লাখ হল বিষাক্ত সাপের কামড়। এর মধ্যে আবার একাশি হাজার চারশত দশ থেকে এক লাখ সাইত্রিশ হাজার আটশত আশি জনের মত মানুষ মারা যায়। আর এর থেকে তিনগুন মানুষের সাপের বিষের প্রভাবে অঙ্গহানি ঘটে [২]। এই আক্রান্তের বেশিরভাগ ঘটনাই ঘটে আফ্রিকা, এশিয়া এবং দক্ষিন আমেরিকাতে। কিন্ত অস্ট্রেলিয়াতে সাপের কামড় এবং মানুষ মারা যাওয়ার সংখ্যা খুবই কম। এই সংখ্যা এতই নগন্য যে তা এশিয়া , আফ্রিকা , দক্ষিন আমেরিকার ধারেকাছেও না। অস্ট্রিলিয়ান ব্যুরো অফ স্ট্যাটিস্টিকসের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০০৮ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এখানে সাপের কামড়ে মারা যাওয়ার সংখ্যা তেইশ জন [৩]। অস্ট্রেলিয়ান করোনিয়াল ডেটার তথ্যানুসারে ২০০০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সাপের কামড়ে মারা যায় ২৭ জন। ২০০১ থেকে ২০১৩ এর রিপোর্ট অনুযায়ী হসপিটালে নেওয়ার প্রয়োজন হয় এরকম সাপের কামড় দ্বারা আক্রান্ত হয় ছয় হাজার একশত তেইশ জন [৪]। শুনে আশ্চর্য হবেন অস্ট্রেলিয়াতে এর থেকে বেশি মানুষ মারা যায় গরু এবং ঘোড়া দ্বারা আহত হয়ে।
এসব কারণে অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানীরা অস্ট্রেলিয়ার বিষাক্ত সাপদের ডেডলি বা মৃত্যু বয়ে আনে এরকম কোন উপমা দিতে নারাজ। অস্ট্রেলিয়ার সাপ বিষাক্ত হতে পারে কিন্ত তারা ডেডলি নয়। তাদের মতে এই সাপদের ডেডলি উপমা দেওয়া ভুল এবং মিথিক্যাল বা পৌরাণিক কোন অবস্থান। অস্ট্রেলিয়ার কমনওয়েলথ সায়েন্টিফিক এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ ওরগানাইজেশন (CSIRO) তাদের এ অবস্থান জানায়। তাদের মতে সারাবিশ্বে সাপের কামড়ে যে পরিমাণ মানুষ আক্রান্ত হয় সে তুলনায় অস্ট্রেলিয়াতে সাপের কামড়ে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা কিছুই না। এখানে তারা কিছু ফ্যাক্টরের কথা তুলে ধরেন যে ফ্যাক্টর সমূহ এত কম ব্যক্তি আক্রান্ত হওয়ার পিছনে মূল ভূমিকা রাখে। হাই কোয়ালিটি অ্যান্টিভেনম, প্যারামেডিক্যাল সারভিস এবং ফাস্ট এইড চিকিৎসার ব্যাপারে কোয়ালিটি সম্পন্ন জ্ঞান সাপের কামড়ে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা কমিয়ে দেয়।
এছাড়াও তারা উল্লেখ করেন যে অস্ট্রেলিয়াতে অনেক বিষাক্ত সাপ থাকলেও ভাইপার প্রজাতির কোন সাপ নেই। ভাইপার প্রজাতির সাপেরা সাধারণত খুব রক্ষণশীল হয়ে থাকে যে কারণে এদের মুখোমুখি হয়ে কামড়ে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। এছাড়াও যেসমস্ত দেশে সাপে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা খুব বেশি তার বেশিরভাগই ঘটে কৃষি জমিতে। সেখানকার লোকদের প্রতিষেধক জ্ঞান এবং সাপে কামড় থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য জুতোর ব্যবহার আর প্রাথমিক চিকিৎসার জ্ঞান নেই বললেই চলে [৫]। এছাড়াও অস্ট্রেলিয়ার বেশিরভাগ বিষাক্ত সাপেরই অবস্থান দূরবর্তী মরুভূমি এলাকায়। প্রত্যন্ত অঞ্চলের কঠিন আবহাওয়ার কারণে সেখানে মানুষের অবস্থান নেই বললেই চলে। যেমনঃ ইনল্যান্ড তাইপান কে পাওয়া যাবে শুধুমাত্র দক্ষিন অস্ট্রেলিয়া এবং পশ্চিম কুইন্সল্যান্ডের মরুভূমিতে । এ সাপ অনেকটাই অধরা। অর্থাৎ দেখতে চাইলেই এর দেখা পাওয়া যাবে না। এদের অবস্থান এমন জায়গাতে যেখানে মানুষের দেখা পাওয়া যায় না বললেই চলে । তাই ইনল্যান্ড তাইপান দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। শুধুমাত্র ২০১৬ সালে এক বালকের এই সাপ দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার খবর আলোচিত হয় এবং সেই সাপ ছিল সেই বালকের নিজ অ্যাকুরিয়ামে বন্দি করা সাপ যা দ্বারা সে হ্যান্ডেল বা ঘাটতে গিয়ে আক্রান্ত হয় [৬]। এছাড়াও অস্ট্রেলিয়াতে বিষাক্ত সাপের অ্যান্টি ভেনমের সহজলভ্যতাও মৃত্যুর সংখ্যা কম হওয়ার এক ভাইটাল কারণ। অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম বিষাক্ত সাপ টাইগার স্নেকের অ্যান্টিভেনম সেই ১৯৩০ সালেই তৈরি হয়ে যায়।
এছাড়াও ১৯৬২ সালের মধ্যে প্রধান প্রধান বিষাক্ত সাপের (তাইপান, ব্রাউন, ডেথ অ্যাডার, পাপুয়ান ব্লাক, সি স্নেক) অ্যান্টি ভেনম তারা তৈরি করে ফেলে [৭]। ডেথ অ্যাডার হল পৃথিবীর অন্যতম আগ্রাসী এবং বিষাক্ত সাপ। এর কামড়ে অ্যান্টি ভেনম গ্রহণ না করা হলে ছয় ঘন্টার মধ্যে মৃত্যু নিশ্চিত। কিন্ত এর অ্যান্টি ভেনম ১৯৫০ সালেই তৈরি হয়ে যায় [৮]।
অস্ট্রেলিয়ার সব বিষাক্ত সাপই যে মরুভূমিতে থাকে ব্যাপারটি কিন্ত এরকম নয়। বিশেষ করে ব্রাউন স্নেক এবং টাইগার স্নেকের সাথে মানুষের মুখোমুখি হওয়ার ঘটনা অনেক ঘটে থাকে । কিন্ত তাদের স্নেক রেসকিউ টিম এবং অ্যান্টি ভেনমের কারণে এ দ্বারা মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনা খুবই কম ঘটে থাকে। সাপে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা কিভাবে শূন্যের দিকে আনা যায় সে নিয়ে রীতিমত চেষ্টা প্রচেষতা চালিয়ে আসছে অস্ট্রেলিয়ার গবেষকেরা। অস্ট্রেলিয়ার নেওয়া পদক্ষেপ সমূহ এশিয়া , আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকা গ্রহণ করলে সাপের কামড়ে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা আশা করি কমানো যেতে পারে।
তথ্যসমূহের সোর্সঃ
[২] https://www.who.int/news-room/fact-sheets/detail/snakebite-envenoming
[৬] https://www.abc.net.au/news/2019-02-23/search-for-worlds-most-dangerous-snake-inland-taipan/10790198
[৭] https://www.nps.org.au/australian-prescriber/articles/antivenom-update-1
[৮] https://www.abc.net.au/news/2018-12-10/death-adder-snake-relocation-study/10564412
[…] আমাদের এ বিষয়ে আগের আর্টিকেল ‘ অস্ট্রেলিয়াতে সাপে কাটা রোগী এত কম… […]