ডেভিড অ্যাটেনবরোর সিন্দুকের প্রাণীরা – প্রথম পর্ব

ডেভিড অ্যাটেনবরোর সিন্দুকের প্রাণীরা – প্রথম পর্ব

Spread the love

 

প্রকৃতিবিদ ডেভিড অ্যাটেনবরো কে জিজ্ঞেস করা হয় যদি তাকে দশটি প্রাণীকে রক্ষার জন্য বলা হয়  বা দশটি প্রানীকে তার কোন কল্পিত সিন্দুকে  জায়গা করে দেওয়ার কথা বলা হয় তাহলে তিনি কোন দশটি প্রাণীকে আলাদা করবেন । একজন প্রকৃতিবিদের জন্য এ কাজটা অত সহজ নয়। বিশেষ  করে এরকম ব্যক্তির জন্য যে তার জীবনের সিংহভাগই কাটিয়েছেন প্রকৃতির মধ্যে। অ্যাটেনবরো বলেন,

এটা এক অসম্ভব কাজ। আমি ঐ প্রাণীদের বাছাই করতে পারি যারা সর্বদা খবরের  শিরোনাম হয়ে আসে । যেমনঃ জাদুকরী বাঘ, অসাধারণ মেরু ভাল্লুক, সুন্দর বরফের লেপার্ড বাঘ, অথবা বিশাল শরীরের পাহাড়ি গরিলা । এদের কাউকেই আমি হারাতে চাই না। কিন্ত এগুলোর বাহিরেও আরো অনেক অসাধারণ প্রাণী রয়ে গিয়েছে যাদের হয়তবা কোন আলাদা  খ্যাতি নেই , হয়তবা অনেকে এদের নামই শুনেনি। আমি এরকম দশটা প্রাণীকে বাছাই করব। যাদের জীবন আমাকে মুগ্ধ করে।

তাহলে এক এক করে দেখে নেওয়া যাক অ্যাটেনবরো কোন কোন মুগ্ধ করা প্রাণীদের বাছাই করেছেন। প্রথম পর্বে আপনাদের স্বাগতম। 

প্রথম পছন্দঃ

বানর হল প্রথম পছন্দ। অনেক রকমের বানরের মাঝে যে বানরকে তিনি তার সিন্দুকের জন্য আলাদা করেছেন তা হল ট্যামারিন বানর। এর মূল আবাস দক্ষিন আমেরিকায়। ট্যামারিনের মধ্যেও বিভিন্ন প্রকার রয়েছে । এদের মধ্যে আছে মোচওয়ালা এমপেরোর ট্যামারিন (emperor tamarin), উদ্ধত দৃষ্টির পাইড ট্যামারিন (pied tamarin), এবং অসাধারণ গোল্ডেন লায়ন ট্যামারিন (golden lion tamarin)।

কিন্ত এ তিনটির বাহিরে যে ট্যামারিন তার মূল পছন্দ তা হল ব্লাক লায়ন ট্যামারিন (black lion tamarin)।ট্যামারিনকে প্রথম দেখায় অন্য বানরদের মত দেখালেও এর অনেক বৈশিষ্ঠ্য আছে যা অন্য বানর থেকে তাকে আলাদা করে। তার মুখমন্ডল বানরের মত। কিন্ত তার হাতের দিকে তাকালে বিশেষত্ব ধরা দিবে। তাদের আঙ্গুলের শেষে কোন নখ নেই , যা আছে তাহল পাঞ্জা। তারা মূলত পোকামাকড়, ফল এবং গাছের রস খায়। ব্লাক লায়ন ট্যামারিনের অস্তিত্ব এখন হুমকির সম্মখীন। শুধুমাত্র এক হাজারের মত টিকে আছে।

আর তাদের নিয়ে এ ব্যাপারে এক অসাধারণ গল্প আছে। ব্লাক লায়ন ট্যামারিনের ব্যাপারে ভাবা হয়েছিল যে তারা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। ১৯৭০ সালে সাও পাওলোর এক ছোট বনে তাদের অস্তিত্ব পুনরায় আবিষ্কৃত হয়। ট্যামারিন মূলত সাও পাওলোতে গাছের কুটুরে বসবাস করে। এর বেশিরভাগই কাঠঠোকড়ার পুরানো বাসা।

তাদের আসল আবাসের মাত্র তিন পার্সেন্ট টিকে আছে। এক সময় তারা পুরো বন জুড়ে থাকলেও তাদের আবাস রীতিমত ছোট পরিসরে পরিণত হয়েছে। তাদের আবাসের বেশিরভাগই আখ চাষ এবং গবাদি পশুর চারণ ভূমি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। যা ট্যামারিনের অস্তিত্ব কে হুমকির সম্মখীন করে। কিন্ত সেখানকার কিছু লোক পূনরায় বন কে ফেরত আনার জন্য কিছু প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে। যে প্রজেক্টের আওতায় গাছ কাটার বদলে স্থানীয় জনগণকে গাছ রোপনের বিনিময়ে অর্থ প্রদান করা হয়।

হয়তবা পুরো বনকে ফিরে পাওয়া সম্ভব নয় কিন্ত টিকে যাওয়া বনের জন্য করিডোর বা রুক্ষাকবচ হিসেবে কাজে দিবে। যা টিকে যাওয়া ট্যামারিন বানর কে বাড়তি নিরাপত্তা দিবে।   

দ্বিতীয় পছন্দঃ

অ্যাটেনবরো দ্বিতীয় যে প্রাণীকে তার সিন্দুকের জন্য পছন্দ করেন তা হল বড় এক প্রাণী। যার রয়েছে অতি প্রাচীন এক ইতিহাস। গন্ডার ,গত পঞ্চাশ মিলিয়ন বছর ধরে এই পৃথিবীর বুকে টিকে আছে। এদেরকে শুধুমাত্র আফ্রিকার সাভানা এবং এশিয়ার কিছু বনে পাওয়া যায়। বর্তমানে পৃথিবীতে পাঁচ প্রজাতির গন্ডার আছে। আর তাদের সবাই বিপন্ন শ্রেণীভুক্ত। পাঁচ প্রকারের মধ্যে সম্ভবত সবথেকে বেশি হুমকির সম্মুখীন হল সুমাত্রার গন্ডার।এই প্রজাতির শুধুমাত্র দুইশত প্রকৃতিতে বাকি রয়েছে। তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করা অনেক জরুরী হয়ে পড়েছে। তা যদি বন্দি প্রজনন (captive breeding) ব্যবস্থার মাধ্যমে হলেও তা করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। কিন্ত সুমাত্রান গন্ডার খুব স্বাধীন প্রানী। মহিলা এবং পুরুষ গন্ডার কে একত্রিত করা খুব কঠিন কাজ সমূহের মধ্যে একটি। আন্দালাস হল এক্ষেত্রে এক পুরুষ সুমাত্রান গন্ডার।

তার ভালবাসার গল্প খুবই হৃদয় স্পর্শ করা। অন্যান্য সুমাত্রান গন্ডারের মত তার পিঠেও চুল রয়েছে। কিন্ত এর পাশাপাশি তার চোখে ঝিকিমিকি চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। হয়তবা সে বাবা হতে চলেছে যে কারণে এই চিহ্ন। আন্দালাসের এখন বসবাস হল সুমাত্রার এক বনে । কিন্ত আশ্চর্য হলেও সত্য তার জন্ম আমেরিকাতে। সিনসিনাটি চিড়িয়াখানাতে (Cincinnati zoo) তার জন্ম। আনদালাসের বংশধারা টিকিয়ে রাখতে তাকে সুমাত্রায় ফিরিয়ে আনা হয়। আন্দালাসের নতুন আবাসস্থল হয় কাম্বাস ন্যাশনাল (Kambas National Park) পার্কের কাছে গন্ডার অভয়ারণ্য (Rhino Sanctuary)তে।

এই অভয়ারণ্যের মূল দায়িত্ব হল গন্ডারের প্রজনন প্রোগ্রাম চালু করা। এই প্রোগ্রামের পুরুষ গন্ডারের স্থান বহু বছর ধরে খালি পড়ে ছিল। অভয়ারণ্যে যদিও আরেকটি পুরুষ গন্ডার আছে কিন্ত সে প্রজননে ব্যর্থ প্রমাণিত হয়। এই আশ্রয়স্থলেরই ভেট  ডাক্তার দেদি কান্দ্রা (Dedi Kandra) । দেদি কান্দ্রা এবং তার টিম নতুন অতিথিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আন্দালাসের স্বাস্থ্য ভাল এবং তার শুক্রানু আছে। প্রজননের প্রধান দুই ফ্যাক্টরই বিদ্যমান। কিন্ত আন্দালাসের জন্য সঠিক ভালোবাসার পাত্রী খুঁজে পাওয়াটাই মুশকিলের ব্যাপার ছিল। আরেকটি মহিলা গন্ডার যার নাম রাতু। রাতুর জন্ম হয়েছে বনে। রাতু বড়ও হয়েছে বন্য পরিবেশে। তাই রাতুর আচরণ একটু আলাদা।

মহিলা গন্ডারের মিলিত হওয়ার সুযোগ শুধুমাত্র তখন আসে অল্প সময়ের জন্য যখন তারা গর্ভধারনের জন্য পরিপূর্ণ হয় এবং যদি সঠিক মেজাজে পাওয়া সম্ভব হয়। ভুল সময়ে তার ভালোবাসার পাত্রের সাথে পরিচয় ঘটালে হিতে বিপরীতও হতে পারে। তাদের বর্ডার লাইন খুবই শক্তিশালী। কিন্ত রাতু আন্দালাসের আমেরিকান ছোয়ায় মজে উঠে।অবশেষে রাতু গর্ভধারণ করতে সমর্থ হয়।

রাতু যদি সুস্থ বাচ্চাদানে সক্ষম হয় তাহলে এটা প্রথম কোন সুমাত্রা গন্ডারের বাচ্চা হবে যা বন্দি প্রজনন ব্যবস্থার ফসল। গন্ডারের গর্ভকাল দীর্ঘ ষোল মাস। আশ্রয়স্থলের কর্মীদের জন্য একেকটা দিন দীর্ঘ হতে থাকে। কেননা এর পূর্বে তারা ব্যর্থ হয়েছিল। তাই রাতুর যত দিন যাচ্ছে ততই তারা চিন্তিত হয়ে পড়ছিল। অবশেষে রাতু নির্দিষ্ট দিনে এক বালক বাচ্চা জন্ম দিতে সক্ষম হয়। এই পদ্ধতি গন্ডারের প্রজাতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে কাজে দিবে আশা করা যায়।

তৃতীয় পছন্দঃ

অ্যাটেনবরো তিন নাম্বারে যে প্রাণীকে বাছাই করেন পৃথিবীতে তার টিকে থাকার বয়স গন্ডারের থেকেও অনেক বেশি। পয়ষট্টি মিলিয়ন বছর পূর্বে পৃথিবীতে যখন মাংসাশী ডাইনোসর টি-রেক্স রাজত্ব করে বেরিয়েছে তখন অ্যাটেনবরোর এই পছন্দের প্রাণীটি নিজেকে টি-রেক্সের পাশে জায়গা করে নিয়েছিল। যদিও সে এক ক্ষুদ্রাকৃতির  প্রাণী। এর আছে পশম, গরম রক্ত , এ ডিম পারে না , গর্ভধারন করে, এবং বাচ্চাদেরকে দুধ পান করায়। এ প্রাণীটির নাম হল সলিনোডন্স  (Solenodons)।

এই ছোট প্রাণিটি অধরা এক প্রাণী। এর দেখা পাওয়া খুবই ভার। তাদেরকে একমাত্র আবাস  ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের ডোমিনিক রিপাবলিকের এক ছোট দ্বীপে। সলিনোডন্সের আবাস মূলত মাটির নিচে। যখন প্রকৃতি নিরব হয়ে যায় তখন এরা মাটির নিচ থেকে বের হয়ে আসে। সলিনোডন্সের ব্যাপারে জানার পরিধি খুবই কম। তাই এক দল গবেষক সলিনোডন্সের ব্যাপারে জানার জন্য আইল্যান্ডে অবস্থান গ্রহণ করে। গবেষকেরা রাতে বের হয় সলিনোডন্স ধরার জন্য। সলিনোডন্স কে খুঁজে বের করার জন্য তাদের ইনফ্যারেড আলোর প্রয়োজন পড়ে। অবশেষে অনেক কষ্টে তারা এক সলিনোডন্স কে ধরতে সমর্থ হয়। এই গবেষক টিমের লিডে রয়েছেন জো নুনেয মিনো (Joe Nunez mino)। অল্প সংখ্যক স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে সলিনোডন্স এক মাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণী যার কামড়ে বিষ রয়েছে। এবং তাদের নাকটিও বড় অদ্ভুত। 

এদের অদ্ভুত বল (টেস্টিকল) রয়েছে যা তাদের লম্বা নাক এবং মাথার খুলির (স্কাল) মাঝে সংযোগ স্থাপন করে। গবেষক দল তাদের ধরা সলিনোডন্সেকে রেডিও কলার পড়ায় যাতে করে এর চলাফেরা অবলোকন করতে সহজ হয় এবং পরবর্তীতে খুঁজে পেতেও সুবিধা হয়। সলিনোডন্সের লাইফ স্টাইল বুঝার জন্যই মূলত এই কলার পড়ানো। পয়ষট্টি মিলিয়ন বছর ধরে টিকে থাকা প্রাণী হল সলিনোডন্স। কিন্ত তাদের সংখ্যা এখন দিনদিন অতি দ্রুততার সাথে কমেই চলেছে। ক্যামেরা ট্রাপে ধরা পড়ে যে সলিনোডন্সের মূল শত্রু  হল মূলত মানুষ দ্বারা এ দ্বীপে নিয়ে আসা বিড়াল এবং কুকুরেরা।

যো, মনে করেন যদি গৃহপালিত প্রাণীদেরকে কন্ট্রোলে আনা সম্ভব হয় তাহলে আশা করে যায় সলিনোডন্সের সংখ্যা আবারো বৃদ্ধি পাবে।  অ্যাটেনবরোর কাছে সলিনোডন্সের যে দিকটা সবচেয়ে আকর্ষনীয় এবং চমকপ্রদ তাহল এরা হল মহান সারভাইভার। সলিনোডন্স এ দ্বীপে টিকে রয়েছে কোন রকম মানুষের সাহায্য ছাড়াই। তাদের টিকে থাকার জন্য একটু সাহায্যের প্রয়োজন। তারা ইউনিক । আমরা যদি এদের হারিয়ে ফেলি তাহলে এদের মত অন্যকোন জীবের সন্ধান আর আমরা পাব না।

তথ্যসূত্রঃ BBC এর Natural World ডকুমেন্টারি অবলম্বনে।

চলবে…………

One thought on “ডেভিড অ্যাটেনবরোর সিন্দুকের প্রাণীরা – প্রথম পর্ব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *